'মাটির ব্যাংকে জমানো সিকি-আধুলির ঝনঝন শব্দের মতো, জীবনের বড়বেলায় শৈশব-কৈশোর-যৌবনে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিরা আওয়াজ তোলে মনের গহিন অন্দরে।' পলি শাহীনার একটি গল্পের এই বাক্য আমাদের বইটির মূল সুরটা ধরিয়ে দেয়। পড়তে পড়তে মনে হবে গল্পগুলো নগরের, নাগরিক জীবনের। বটেই। কিন্তু নাগরিক মানুষের ডুবন্ত চেতন থেকে স্মৃতির স্বরে যখন বার বার ডেকে ওঠে আজন্ম শৈশব, দিগন্ত বিস্তৃত অকৃত্রিম জীবন, গল্পটি তখন আর এককভাবে নগর কিংবা নাগরিকের থাকে না। স্মৃতি কি কেবল মানুষের, নগরের থাকে না? বিজয় সরণীতে ভি. আই. পি মুভমেন্টে সাধারণের জীবন যখন থমকে যায় স্থিরচিত্রের মতো, তখনই যে মহুয়ার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তমালের হাত ধরে হেঁটে আসে শিমুলতলা কোনো এক প্রাইভেট কারের ভেতর, তা ছড়িয়ে পড়ে নগরের স্মৃতিতেও। আমাদের মতো এই নগরও শৈশবহারা, অপার্থিব সেই সময় তাই বার বার পলি শাহীনার চরিত্রদের জাগিয়ে দেয় স্বপ্নে। একদিকে 'পার্থিব' জামাল, অন্যদিকে 'অপার্থিব' তনিমা-একই ছাদের নিচে বাস। না, তনিমারা অলৌকিক কোনো মানুষ না, জামালদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ। কিন্তু যে মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে কান্তিহীন মিথ্যাজীবনে, সেই মানুষ তো তনিমা না! রক্তমাংসের বাস্তবতা যেখানে কলুষিত, অসুস্থ; সেখানে থেকেও তনিমাদের বাস বিমল স্মৃতিতে-কখনো স্মৃতি নিজে আসে নগরের স্মৃতি হয়ে, কখনো তনিমারা যায় স্মৃতির কাছে। এভাবে এই সংকলনে পলি শাহীনা সুকৌশলে দুটি জীবনই একসঙ্গে অঙ্কন করেছেন-ভীষণ কোলাহলের মধ্যে নৈঃশব্দ্য, প্রচণ্ড ভণ্ডামির মধ্যে বিমল বসে থাকা, তীব্র ভাঙচুরের মধ্যে নিশ্চল হেঁটে যাওয়া, উৎকট গন্ধের মধ্যে সুরের সুঘ্রাণ...! তাই বলা চলে, গল্পগুলো বিপরীতমুখী দুই জীবনের- জীবনটা কখনো নগরের, কখনো ব্যক্তির। জীবন যেখানে যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অনাহুত, সেখানে স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঝে একান্তে বেঁচে থাকার উত্তম দাওয়া হতে পারে এই গল্পগুলো। তার মানে কি গল্পগুলো জীবনবাদী না? নিশ্চিত করেই জীবনবাদী, যে জীবন বৃত্তের বাইরে।