আমি হতাশাগ্রস্ত। আমার সংস্কৃতি নিয়ে, আমার স্বাধীনতা, আমার বাকস্বাধীনতা, আমার দেশ, আমার প্রিয়তম বাংলাদেশ, বাংলাদেশের শিল্পকর্ম নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত। আমি ভীষণ ক্রুদ্ধ! আমি আমার প্রিয়তম বাংলাদেশকে ঢের বেশি ঘৃণা করি। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, আমলাতন্ত্র, পুঁজিবাদ, আর উগ্রবাদের কত্থক নৃত্য‒ যখন প্রতিদিনের ব্রেকিং নিউজ; সকালবেলার ধোঁয়া ওঠা গরম কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আমি আমার হৃৎকম্পন টের পাই, আমি শিহরিত হয়ে উঠি, আমার ভয় হয়, কিন্তু আমি ভয় পাই না; আমি পড়তে থাকি খুন, আমি বিস্মিত হতে পারি না; আমি পড়তে থাকি ধর্ষণ আমি কিছুতেই বিস্মিত হতে পারি না। আমি পত্রিকার পাতায় পাতায় দেখতে পাই রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলনামা; উত্তর দিক থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে উগ্রবাদ, দক্ষিণ দিকে আওয়াজ তুলছে উগ্রবাদ; পূর্ব দিকে গ্রেনেড হামলা, নিহত অর্ধশতাধিক। পশ্চিমে সংখ্যালঘুদের ইজ্জত নিয়ে টানাহেঁচড়া। আমি পড়তে থাকি, আমি মুখস্থ করতে থাকি, আমি ভুলে যেতে থাকি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আপাদমস্তক। আমি রাজনীতি বুঝি না, তবে নীতিতে আমি একদম পাক্কা খেলোয়াড়। আমি প্রতিদিন নীতিনামক খেলায় মেতে উঠি, কিন্তু আমি কিছুতেই পেরে উঠি না, কারণ আমিও যে একজন সংখ্যালঘু, আমি কবি। আমি কবি, আমি সমাজের অগুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ; আমি কবি, আমি অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মেরুদণ্ডহীন মানুষ। তবে একজনের কাছে আমি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নায়রা, আমার মেয়ে, নামের মতোই দীপ্তিমান সে। ভাবতেই আবেগাপ্লুত হয়ে উঠি আমি। আমি বাবা। আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ বাবা। আর নায়রাও আমার কাছে বড্ড বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি নায়রা পারবে, পেরে উঠবে নায়রা। নায়রা পৃথিবীর সকল নারীদের কাছে কিংবদন্তী হয়ে উঠবে একদিন। আমি সেভাবেই নায়রাকে মানুষ করে তোলার চেষ্টা করছি। নায়রা এখনো অনেক ছোট, অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তবে তার মুখ থেকে এখনই উচ্চারিত হয় আগুনের ফুলকি। আমি অবাক হই নায়রাকে দেখে। তাকে নিয়ে আমার মনে বিস্ময় জাগে ভীষণ। মাঝেমধ্যে আমার বিশ্বাস হতে কষ্ট হয়, আমি নায়রার মতো একজন মেয়ের বাবা। আমি জানি, যা পারিনি আমি, যা পারেনি আমার দেশের আবাল জনতা, যা করতে পারেনি আমাদের রাজনীতিবিদগণ; নায়রা পারবে। সে সময় অতি নিকটে। আমি নায়রাকে নিয়েও হতাশাগ্রস্ত। নায়রাকে নিয়ে আমার ভয় হয়, কিন্তু আমি কিছুতেই ভয় পাই না। আমি সময় পেলেই নায়রাকে নিয়ে মেতে উঠি আমাদের সমকালীন জীবনযাত্রা এবং উত্থানপতনের লাল-নীল নকশায়।
জীবন ও যৌবনের কবি অন্ত মিলন। কবি ভালোবাসা এবং বিপ্লবকে তাঁর নিজস্ব চেতনায় বেঁধে কবিতা-র এক ত্রিমাত্রিক শরীর গঠনে - তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা জানান দিচ্ছেন পাঠকমহলে অহর্নিশ। মৌলবাদ, উগ্রবাদ, পুঁজিবাদ, আমলাতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, রাজনীতি,- তাঁর কবিতায় এক অকল্পনীয় মাত্রা যোগ করেছে। তিনি ভয়কে জয় করে ভালোবাসার আপাদমস্তক লিপিবদ্ধ করেছেন আঁধারে বসে। তিনি নিজেকে ভেঙেছেন বহুবার। একাধারে সৃষ্টি করেছেন উপন্যাস, গান ছোটগল্প, ও নাটক। এ গেলো সৃষ্টির কথা। সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি অভিনয় করেছেন মঞ্চ ও টিভি নাটকে একাধিকবার, করেছেন মডেলিং। পেয়েছেন ভক্ত ও ভালোবাসা। তবুও তিনি বারংবার ছুটে যান বেদনার কাছে। দুঃখের ভেতরে কানামাছি খেলতে খেলতে তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ' দুঃখের ভেতরে খেলছি কানামাছি ' ( একুশে বই মেলা - ২০০৩) উপন্যাস, ' চন্দনপুর নগর এবং একজন শাহরিয়ার ' (একুশে বই মেলা - ২০০৪) নারীবাদী উপন্যাস, 'কথা ও একটি পাথর নদী' ( ২০০৮ ) 'কথা ও একটি পাথর নদী' উপন্যাসটি প্রতিক্রিয়াশীলদের অযৌক্তিক আন্দোলন ও ২৫৬২ আলেমসহ বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতি এবং কঠোর কর্মসূচির কারণে বাজেয়াপ্ত হয়। তবুও সাহসী কবি থেমে থাকেননি, ২০১৩ একুশে বই মেলায় আরও একটি কাব্যগ্রন্থ ' ডাস্টবিনে একটি জারজ এবং একটি দাঁড় কাকের ঠোঁট ' নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি হন। এরপর দীর্ঘ নয় বছর কবিতা-র নিখুঁত পোস্টমর্টেম করে তিনি কবিতাকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। অতঃপর, (একুশে বই মেলা ২০২৩) বের হয় তাঁর সর্বাধিক বিক্রিত কাব্যগ্রন্থ ‘হৃৎপিণ্ডের বনভোজন’। আর এবার পাঠকের মুখোমুখি হলেন, অশুভ আঁধারে এক দীপ্তিমান উপন্যাস ‘নায়রা’ নিয়ে। নায়রা বেঁচে থাকুক প্রতিক্রিয়াশীল অশুভ জনগোষ্ঠীর মাঝে এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে হাজার বছর।