১৯৫২ সালে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফর করেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিজের নোট খাতায় টুকে নিলেও তখন তখনই পুরোপুরি লিখে উঠতে পারেননি। লেখার অবসর মেলে ১৯৫৪ সালে, কারাগারে বসে। প্রায় ৬৫ বছর পর ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় বাংলা একাডেমি থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয় এ ভ্রমণকাহিনি। দীর্ঘ ২৫ দিনের চীন ভ্রমণকে শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একটি ভ্রমণ হিসেবে নেননি, নিয়েছিলেন রাজনৈতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে। সদ্য বিপ্লবের পর চীনদেশের রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা ও মানুষের জীবনযাত্রার কি পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তা বুঝতে ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি নিষ্ঠার সাথে কাজে লাগিয়েছেন। গ্রাম, শহর, কৃষিখামার, হাসপাতাল, কলকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় ও শ্রমজীবী মানুষের বাসস্থান তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিপ্লবের মাত্র তিন বছরের মাথায় চীনের যে অকল্পনীয় পরিবর্তন হয়েছিল তা তরুণ শেখ মুজিবকে অভিভূত করেছে। তাঁকে মুগ্ধ করেছে নয়াচীন সরকারের অকপটতা, সত্যবাদিতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। পিকিং, নানকিং, সাংহাই, ক্যান্টন, হ্যাংচোসহ চীনের বড় বড় শহর তিনি ট্রেনযোগে সফর করেছেন। সাক্ষাৎ পেয়েছেন মহান নেতা মাও সে তুংয়ের। মাওয়ের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা তরুণ শেখ মুজিবকে অনুপ্রাণিত করেছে। ভোরের সূর্য দেখে যেমন সারাদিনের উত্তাপ অনুমান করা যায়, ঠিক তেমনি এই গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টিও আভাস দেয় যে একদিন এই তরুণের হাতেই বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভার অর্পিত হবে। এই শেখ মুজিবুর রহমানই একদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠবেন। বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রস্তুতিকালকে বুঝতে এ গ্রন্থ সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন আদর্শ দেশনেতা ও রাজনীতিবিদই নন, তাঁর ছিলো উল্লেখযোগ্য সাহিত্য প্রতিভা। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে যিনি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার ফলে তাঁকে অভিহিত করা হয়ে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে। মহান এই ব্যক্তির জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর শৈশব কেটেছে গোপালগঞ্জেই, যার ফলে শিক্ষাজীবনের সূত্রপাতও সেখানে। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন, কিন্তু ছাত্র রাজনীতি ও বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি আর পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেন, যার ফলে সরকারের রোষানলে পড়েন। রাজনৈতিক কারণে তিনি দিনের পর দিন জেল খেটেছেন। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভে তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে জেলে আটকে রাখা হয়। এরপর দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে এসে তিনি দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এতকিছুর পরও বঙ্গবন্ধু সাহিত্যকর্মে অংশ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বই ২টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বই সমূহ মূলত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। 'কারাগারের রোজনামচা' ও 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' এই দুটি বই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বই সমগ্র এর অন্তর্ভুক্ত। এই দুটি বই-ই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে। বঙ্গবন্ধু নিজে তেমন বই রচনা না করলেও তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য বই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই এর মধ্যে শেখ হাসিনার লেখা 'শেখ মুজিব আমার পিতা', পীর হাবিবুর রহমানের 'পোয়েট অব পলিটিক্স', ফারুক চৌধুরীর 'স্মরণে বঙ্গবন্ধু', এম আর আখতার মুকুলের 'মুজিবের রক্ত লাল', শেখ শাহাদাতের 'বিপ্লবী নেতা শেখ মুজিব' ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা কতিপয় সেনাসদস্যের হাতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন।