'গোষ্পদে যেমন আকাশের ছায়া পড়ে তেমনি একটুখানি ক্ষুদ্র চিত্রপটের মধ্যেই বিশাল, ব্যপ্ত মহাজীবনের ছায়া পড়বে।' অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন কথাটা। ছোটোগল্প অল্প পরিসরে লেখা বিপুল আয়োজন। ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার কাজী রাফির ছোটগল্পগুলোতে আমরা বৃহৎ এক জীবন এবং সমাজ এবং রাজনৈতিক সময়ের ছায়া খুঁজে পাই। তাঁর গল্পগুলো এমনই ইঙ্গিতবহ বা বলা যায় তাঁর লেখা গল্পগুলো এতটাই নন-লিনিয়ার বা অরৈখিক গল্পকথন যা নিবিড় মনোযোগ ছাড়া বুঝে ওঠাই মুশকিল হয়ে পড়ে। ইউলিসিস লেখক জেমস জয়েসকে সাংবাকিরা এক সময়ে প্রশ্ন করেছিল, 'আপনার গদ্যরীতি এত জটিল কেন?' জয়েসের সহজ জবাব, “মূর্খ সমালোচকদের তিন-শ বছর ব্যস্ত রাখার জন্য।" বাক্য গঠনে নিজস্ব একটা ধরন গড়ে উঠেছে কাজী রাফির। সেটা বোধহয় তৈরি হয়ে গেছে তাঁর অবচেতন মনে এবং মননে। চলিত ভাষার শব্দ বেছে নিয়ে শুদ্ধতম, অনুভবময় এবং কাব্যিক ভাষার গড়নে বিন্যাস করে ফেলেন নিজের বাক্যগুলো। দুই বাংলার সমসাময়িক কোনো লেখকের লেখায় এই ধরনটা দেখা যায় না। প্রায় এক যুগ আগে আমি ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলাম কাজী রাফির উপন্যাস 'ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা' পড়বার সময়। তাঁর লেখালিখির এই বিশেষ ধরনটা অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে আজো। এখানে আরো দুটো কথা না বললেই নয়। কাজী রাফির উপন্যাসের কাহিনি যেমন নদীর মতো ধীরে সুস্থে পরতে পরতে দুইকুল দেখতে দেখতে গিয়ে পড়ে সাগরে, ছোটগল্পে তাঁর কাহিনি কিন্তু ঝপাং ঝপাং করে ঝরনা ধারার মতো ঝরে পড়ে খরস্রোতা নদীতে গিয়ে মিশে যায়। মানুষের মনের অভ্যন্তরীণ কাজগুলোকে প্রতিলিপিতে রূপান্তরিত করার এই কৌশলে তিনি প্রায়শই একটা চরিত্রের মানসিক প্রক্রিয়াগুলোকে একটা অনাবৃত এবং আপাতদৃষ্টিতে অগোছালোভাবে উপস্থাপন করেন। জেমস জয়েস, বা আমাদের বাংলা সাহিত্যের কমলকুমার মজুমদার বা ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখাতে এই বিশিষ্ট কৌশলের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। লেখাতে হেনরি বার্গসনের এই 'স্ট্রিম অফ কনশাসনেস' বর্ণনা কৌশল আত্মস্থ করেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফও। কাজী রাফির বর্ণনাকৌশলে আমরা এই স্ট্রিম অফ কনশাসনেস উপলব্ধি করতে পারি। 'আবির রাঙা এক প্রজাপতি' গল্পগ্রন্থে অধিকাংশ গল্পেই পাঠক আমার কথার সত্যতা খুঁজে পাবেন। এই গ্রন্থের একটা ছোটগল্প 'অঙ্কুর' প্রকৃতপক্ষে একটা চলমান বাস্তবতায় বিক্ষিপ্ত লোভাতুর মানসিকতার মহীরুহ। গল্পকারের অন্য দশটা গল্পের মতো এখানেও, মনে হয় লেখক নিজের দেখা বা নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। অনেক শক্ত শক্ত সত্যি কথা তিনি তাঁর ছোটগল্পে সাহিত্যের মর্যাদা দিয়ে প্রকাশ করেন। প্রচলিত গৎবাঁধা নিয়মে কাজী রাফি কখনোই লেখেন না। 'অঙ্কুর' তেমনই একটা নিয়ম-রীতি ভাঙা গল্প বা বাস্তবতার স্বাপ্নিক রূপ। ছোট্ট এই হাজার চারেক শব্দের 'অঙ্কুর' গল্পের মধ্যেই লেখক মহাকাব্যিক ঢংয়ে ছোটো ছোটো কয়েকটা গল্প বলে গেছেন। সেই সাথে জাদু বাস্তবতার স্পষ্ট মিশ্রণ অনতিক্রম্য সীমারেখা টেনে রেখেছেন। 'আবির রাঙা প্রজাপতি' গ্রন্থের মাইলফলক আরো এক গল্প দিকচিহ্ন রেখে যায় যে ধ্রুবতারা। তিন কিশোরীকে নিয়ে ফাঁদা গল্পে নীতি-ভ্রষ্ট রাজনীতি বা ক্ষয়িষ্ণু এক সমাজের চিত্রই শুধু আঁকেননি; রহস্যময় এই প্লটে কিশোর মননে দানা বাঁধা হাহাকারকে তিনি শেষ একটা লাইনে কি অনন্যভাবে প্রকাশ করেছেন যা আমাদেরও হৃদয়ের হাহাকার হয়ে ওঠে। পাঠকের হৃদয় ভিজে ওঠে। বাকি গল্পগুলো পাঠান্তের প্রতিক্রিয়া আমি পাঠকের হাতেই অর্পণ করলাম। কাজী রাফি তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা'র জন্য পেয়েছেন 'এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার-২০১০' এবং 'এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা-২০১০'। উপন্যাস এবং ছোটোগল্পে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩' এবং 'এমএস রাহী পদক ২০১৯'। —আশরাফ উল আলম শিকদার
কথাসাহিত্যিক কাজী রাফি ১৯৭৫ সালের ২২ নভেম্বর বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী রইচ উদ্দীন এবং মাতার নাম ফিরোজা বেগম। তিনি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ বগুড়া থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশনসহ কমিশনপ্রাপ্ত হন । পরবর্তীতে তিনি নিজ ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন। ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ উপন্যাস তার লেখা প্রথম উপন্যাস। প্রথম উপন্যাসেই তিনি পাঠক এবং বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ , ‘ত্রিমোহিনী’ , রূপডাঙ্গার সন্ধানে’ , ‘পাসওয়ার্ড’ , ‘রংধনুর সাঁকো’, ‘লে জোঁ নদীর বাঁকে’, নিঃসঙ্গতার নগ্ন খোলস’, অরোরার আঙুল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’র জন্য পেয়েছেন ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার-১০’ এবং ‘এম এস ক্রিয়েশন (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ) সম্মাননা’ । উপন্যাস এবং ছোটগল্পে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩ ।