বাংলা ছোটগল্পের বৈচিত্র্যময় জগতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বতন্ত্র শিল্পদৃষ্টির অধিকারী। কল্লোলীয় কালের রোমান্টিক বৃত্ত ভেঙে বিভূতিভূষণ গল্পে এনেছেন চিরায়ত জীবনের শান্ত কোমল স্নিগ্ধ রূপ। পাশ্চাত্যের কৃত্রিম জীবনাবেগ থেকে তাঁর গল্প দূরবর্তী। প্রাচ্য জীবনের সহজাত রূপ তার মহিমা ও মলিনতা নিয়ে বিভূতির গল্পে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাংলা ছোটগল্পে এক লোকোত্তর দৃষ্টির অধিকারী বিভূতিভূষণ। মাটি-প্রকৃতির স্পর্শে লালিত মানুষের তুচ্ছ জীবন লোকায়তের মহিমা পেয়েছে তাঁর গল্পে। ভারতীয় অধ্যাত্মবিশ্বাস, ব্রহ্মচেতনা তথা পারলৌকিক জীবনবোধের সূক্ষ্ম শৈল্পিক বয়নে বিভূতিভূষণের গল্প স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। মর্ত্য-অমর্ত্য, লৌকিক-অলৌকিকের মিশেলে বিভূতির গল্প স্বয়ংস্বতন্ত্র। শাস্ত্র-সংস্কারের আবহমান বন্ধন সত্ত্বেও ধূলিমলিন পৃথিবীর ক্ষুদ্র খণ্ড জীবন প্রস্ফুট হয়েছে তাঁর গল্পে। বিভূতি-গল্পের প্রধান দিক এর হৃদয়ধর্ম ও সহজাত মানবীয়তা। চিরচেনা জীবনের বাইরেও দৃষ্টি ফেলেছেন লেখক। অভাব-দারিদ্র্যপীড়িত লোকায়ত জীবনের সমান্তরালে বিভূতিভূষণ বিহার করেছেন প্রকৃতিলোকে। অরণ্য-প্রকৃতি ও ছায়াচ্ছন্ন গাছপালাও তাঁর গল্পে সংবেদনশীল চরিত্র হয়ে উঠেছে। ভারতীয় প্রকৃতির মধ্যে লেখক অনুভব করেছেন এক অনির্দেশ্য লোকোত্তর সত্তাকে। ঔপনিষদিক ব্রহ্মচেতনাকে বিভূতিভূষণ অনুভব করেছেন বিস্তৃত প্রকৃতি ও জগতের বিচিত্র রূপের মধ্যে। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও বিভূতির প্রকৃতি ব্রহ্মময়, এক সর্বব্যাপী সত্তা সমাচ্ছন্ন করে আছে তাঁর জগৎ ও প্রকৃতিলোককে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।