জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ ‘বাংলাদেশে’ আরবি ভাষা ও সাহিত্য এবং ইসলামি শিক্ষার ঐতিহ্য প্রায় হাজার বছরের পুরানো। সাবেক বৃটিশ ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মতো বর্তমান বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বরাবর পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এখনো রয়েছে। বর্তমানে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশে ইসলামি ও সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে এবং দিন দিন বেড়েই চলেছে। তা সত্ত্বেও আমাদের জানা মতে, বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত আরবি ভাষা ও সাহিত্যের কোনো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়নি। এ কারণে শিক্ষকদের মতো শিক্ষার্থীদেরও পঠনপাঠন এবং পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরবি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থসমূহের অথবা বাজারে সহজলভ্য নিম্নমানের নোট বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিশেষত আরবি ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, জাহিলিয়া যুগের আরবি গদ্য ও বাগ্মিতাসাহিত্য, ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব উপদ্বীপে সর্বকালের সর্বোৎকৃষ্ট আরবি কাব্যসাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ, প্রাথমিক অবস্থা থেকে বিবর্তিত হয়ে আরবি ভাষার সপ্তম শতাব্দীতে নাযিলকৃত আল-কুরআনে ব্যবহৃত কুরাইশি প্রমিত আরবির রূপগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে বাংলা ভাষায় আদৌ কোনো তথ্যানুসন্ধান বা রেফারেন্স পুস্তক না থাকার বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর। আজ থেকে প্রায় পনেরো শ’ বছর পূর্বে আরব উপদ্বীপের যুদ্ধোন্মাদ, উশৃঙ্খল, অত্যাচারী ও ঘোরতর পৌত্তলিক সমাজে আরবি ভাষায় নাযিলকৃত কিতাব আল-কুরআন এবং প্রেরিত ধর্ম ইসলাম ও তার নবিকে সঠিকভাবে জানা, বোঝা ও অনুসরণের জন্য প্রাচীন আরবি ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান অপরিহার্য বলে স্বীকৃত। তাই আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ড (জাহিলিয়া যুগ) বইটি মৌলিক গবেষণা, ব্যাপক অধ্যয়ন, কঠোর পরিশ্রম ও আল্লাহ’র অনুগ্রহের ফসল। বস্তুত, কেবল জাহিলি আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিশেষত সে যুগের আরবি কাব্যসাহিত্যের মাধ্যমেই প্রাক-ইসলামি আরব সমাজের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনাচার সর্ম্পকে পরিপূর্ণরূপে অবহিত হওয়া যায়। তাই একটি প্রাচীন আরবি প্রবাদে বলা হয়েছে العرب الشعرديوان অর্থাৎ কবিতা আরবদের তথ্যভান্ডার। এসব কারণে, বহুদিন থেকেই এ লেখকের মনে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রণয়নের একটা প্রবল বাসনা কাজ করছিল। বর্তমান গ্রন্থটি এ লালিত বাসনারই ফসল। গ্রন্থটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত সাতটি প্রবন্ধের সমষ্টি হলেও প্রবন্ধগুলো শুরু থেকেই এমনভাবে পরিকল্পিত ও রচিত হয়েছে, যেন পরিশেষে এগুলো আরবি ভাষা ও সাহিত্যের জাহিলিয়া যুগসংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের রূপ লাভ করে। ইউরোপীয়গণও তাঁদের প্রাচ্যবিদ্যাচর্চায় আরবি ভাষা ও সাহিত্যকে অগ্রে স্থান দিয়েছেন প্রধানত মধ্যযুগে তাঁদের জরাগ্রস্ত, ক্ষয়িষ্ণু, স্থবির ও পিছিয়ে পড়া ভাষা ও সাহিত্যসমূহকে সঞ্জীবিত, প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ করার জন্য। বিষয়টি এ গ্রন্থের একাধিক স্থানে বিশেষত ‘আরবি কবিতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ প্রবন্ধটিতে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থটিতে আরবি ভাষার উৎপত্তির একেবারে গোড়া থেকে আল-কুরআন নাযিলের শুরু পর্যন্ত আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমোৎকর্ষের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। শেষ প্রবন্ধটিতে আলোচনা করা হয়েছে আল-কুরআনে ব্যবহৃত আরবি ভাষা সম্পর্কে।
নরসিংদী জেলার বেলাব থানার চন্দনপুর গ্রামের সন্তান এ কিউ এম আবদুস শাকুর খন্দকার একই জেলার হাতিরদিয়া স্কুল থেকে প্রাথমিক, সর্বলক্ষণা মাদ্রাসা থেকে দাখিল, কুমরাদি মাদ্রাসা থেকে আলিম ও ফাযিল, ঢাকা আলিয়া থেকে কামিল (১৯৬৭), শিবপুর হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি, করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে বি.এ.অনার্স ও এম.এ (১৯৭৫) সম্পন্ন করেন। আলিম ও এস.এস.সি-তে সরকারি বৃত্তি লাভসহ তিনি ফাযিলে ৫ম, কামিলে ৭ম ও এম.এ.-তে ২য় স্থান লাভ করেন। ১৯৭৯ সনের বি.সি.এস. শিক্ষায় ১ম স্থান অধিকার করে সরকারি কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক নিযুক্ত হন। আরব লীগের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে খার্তুম ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে দুই বছর (১৯৭৯-১৯৮১) শিক্ষণবিজ্ঞান অধ্যয়নের পর সেখান থেকে অনারবদের আরবি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্প্যাশালিস্ট ডিপ্লোমা (এম. ফিল) অর্জন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে ঢাবি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন আরবি শিক্ষক, সউদি দূতাবাসে অনুবাদ ও প্রেস কর্মকর্তা, রেডিও বাংলাদেশ বহির্বিশ্ব কার্যক্রমে আরবি সংবাদ ও কথিকা পাঠক ও অনুবাদক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সভা-সেমিনার-সম্মেলনে দোভাষীর কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৯০ সালে ঢাবি আ.ভা.ই.-তে আরবি ভাষার প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০১৬ সালে অত্র ইনস্টিটিউট থেকে আরবির অধ্যাপক হিসেবে অবসরে আসেন। সরকারি বৃত্তিসহ দেশে ও বিদেশে তিনি ৩টি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষায় পূর্ণ দক্ষতা এবং হিন্দি ও ফার্সি ভাষায় আংশিক দক্ষতার অধিকারী। অনারবদের আরবি ভাষা শিক্ষাদান এবং তাদের জন্য আরবি ভাষার পাঠ্যসূচি তৈরির কাজে লেখকের প্রশিক্ষণ, বিশেষজ্ঞতা ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ঢাবির বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায় তাঁর ২২টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তাঁর আরবি থেকে বাংলায় অনূদিত দুটি বই এবং জাতীয় পত্র-পত্রিকায় স্বরচিত ও অনূদিত বহুসংখ্যক নানাবিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয়। বর্তমানটির পর তাঁর ৩টি আরবিসহ অপ্রকাশিত ৬টি পাণ্ডুলিপি রয়েছে, যেগুলো পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হবে ইন-শা’আল্লাহ। তিনি বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস সমিতি, বিআইআইটি ও ঢাকাস্থ বেলাব সমিতির জীবন সদস্য। এশিয়া ও এশিয়ার বাইরে তাঁর কয়েকটি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্বাধীন অধ্যয়ন, গবেষণাকর্ম এবং লেখালেখি ছাড়াও বর্তমানে তিনি বিআইআইটিসহ শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত এবং নিজ এলাকায় ধর্মীয় ও সমাজোন্নয়নমূলক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত।