মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় শরণার্থী বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি হিসেবে প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এতো কম সময়ে সারা পৃথিবীতে এতো মানুষ দেশান্তরি হয়নি। এই বাস্তুচ্যুতিও গণহত্যা-নির্যাতনের অন্তর্গত। বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে যখন তারা সীমান্তের দিকে যাচ্ছেন তখন অনেকে মারা গেছেন, হত্যা করা হয়েছে। চুকনগরের গণহত্যার কথা ধরা যাক। এ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় চুকনগরে জমা হয়েছেন আশে পাশের এলাকার মানুষজন। সেখানে একদিনে প্রায় দশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। পথে যেতে অনেক নারী ধর্ষিতা হন। শরণার্থী শিবিরগুলিতে মানবেতর অবস্থায় তারা দিন যাপন করেন। সেখানেও মহামারীতে প্রায় চার-পাঁচ লাখ মানুষ মারা যান। এক অর্থে এরা সবাই গণহত্যা- নির্যাতনের অন্তর্গত। গণহত্যার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ শরণার্থী হয়েছিলেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে শরণার্থীদের নিয়ে প্রতিদিন সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। শরণার্থীদের সহায়তার জন্য বিশ্ব সিভিল সমাজ পথে নেমে এসেছে। যদি বলি 'শরণার্থী'রাই 'বাংলাদেশ' নামটির ব্রান্ডিং করেছিল তাহলে বোধহয় ভুল হবে না। এক কথায় বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করেছিল শরণার্থীরা। এটি শরণার্থী বিষয়ক কোনো অভিসন্দর্ভ নয়, শরণার্থীরা কী ভাবে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমতের সৃষ্টি করেছিল তার একটি বয়ান যা নিয়ে চর্চা প্রায় হয় নি বললেই চলে। এবং এ কারণেই বর্তমান বইটি নির্মিত হলো। ইতোমধ্যে এ সেক্টর নিয়ে মুনতাসীর মামুনের পাঁচটি গ্রন্থ বেরিয়েছে। এখন বের হলো ষষ্ঠ গ্রন্থ। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মুনতাসীর মামুনের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার গুলবাহার গ্রামে, কিন্তু তিনি ঢাকার ইসলামপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। সেখানেই পোর্ট ট্রাস্ট প্রাইমারি ও হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নেন। পরে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন এবং একই বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবনে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন, কাজ করেছেন ‘দৈনিক বাংলা বিচিত্রা’য়। এছাড়াও স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনের সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে প্রভাষক পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপরই তার বিভিন্ন অনুবাদগ্রন্থ, চিত্র সমালোচনা এবং ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ইতিহাসের প্রতি তার ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট' প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার ইতিহাসকে তিনি প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান- এই উদ্দেশ্যেই মুনতাসীর মামুনের বই লেখা। একজন শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক। ঢাকা শহর নিয়ে তার রয়েছে গবেষণাপত্র। গড়ে তুলেছেন ‘সেন্টার ফর ঢাকা স্টাডিজ’ নামের ইতিহাস চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে মুনতাসীর মামুন এর বই সমগ্র তথা ১২টি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মননশীল এই লেখক দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে লিখে যাচ্ছেন নানা বিষয়ে। মুনতাসীর মামুন এর বই সমূহ এর বিষয় বহুমাত্রিক। তার গ্রন্থের সংখ্যা ২২০, যাতে স্থান পেয়েছে গল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা এবং অনুবাদ সাহিত্য। শিশু-কিশোরদের নিয়েও তার লেখা গ্রন্থ প্রশংসা কুড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তার সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বর্তমানে এই ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।