ভূমিকা বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক বিক্রিত লেখক ডেল কার্নেগির চিন্তাশক্তির বিকাশ ও সমৃদ্ধি বিষয়ক তিনটি গ্রন্থের সংকলন “চিন্তাশক্তির বিকাশসমগ্র।” ডেল কার্নেগি মনে করেন, শুধু পরামর্শ দিয়ে কাউকে সাফল্যের পথে পরিচালিত করা যায় না যদি সে চেষ্টা না করে। তিনি বলেন, বার্নার্ড শ একবার মন্তব্য করেন : ‘কোনো লোককে কিছু শেখাতে চাইলে সে কখনই শিখবে না, যদি সে শেখার জন্য ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে না দেয়।’ শ ঠিকই বলেছিলেন। শিক্ষা হলো একটা সজীব পদ্ধতি। আমরা কাজ করার মধ্য দিয়েই শিখি। অতএব এ বই পড়ে নীতিগুলো যদি আয়ত্ত করতে চান তাহলে কিছু করতে হবে। সুযোগ পেলেই নীতিগুলো কাজে লাগান। তা না করলে অচিরেই ভুলে যাবেন। যে জ্ঞান কাজে লাগানো যায় তাই মনে গেঁথে যায়। আপনি হয়তো এই সব নীতি একেবারে কাজে লাগাতে অসুবিধা বোধ করতে পারেন। ব্যাপারটা আমি ভালোই জানি যেহেতু বইটা আমারই লেখা। আমি নিজেও অসুবিধা বোধ করি। তাই বইটা যখনই পড়বেন তখনই মনে রাখবেন শুধু খবর সংগ্রহ করার জন্যই বইটা পড়ছেন না। আপনি নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে চাইছেন। হ্যাঁ, আপনি নতুন জীবন যাপনের উপায় খুঁজছেন। এজন্য দরকার ধৈর্য আর প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহার। সুতরাং পাতাগুলোয় মাঝে মাঝেই চোখ বোলান। বইটিকে দুশ্চিন্তা জয় করার কাজে লাগানোর বই ভাবুনÑআর কোনো উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে চঞ্চল হবেন না। তার বদলে বইটার পাতা উল্টে অধ্যায়গুলো পড়ুন। এটা করলে দেখবেন জাদুর মতোই কাজ হবে। তুমি যদি সাফল্য পেতে চাও, তবে দুশ্চিন্তা নামক ব্যধিকে জয় করো, তবেই সাফল্য তোমার কাছে ধরা দেবে। তুমি কাজ না করে সাফল্য পেতে পারো না। জীবনে সাফল্য লাভের জন্য তোমার মনের মধ্যেই একটা বিশাল শক্তি আছে। এর আগে তোমাকে একটা কথা অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন আর তা হলো : তোমার নিজের মনটাকেই আগে ভালোভাবে জেনে নাও, তারপর নিজের মতো করে জীবন কাটাও। দেখবে, তুমি তোমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি খুঁজে পাবে। নিজের ভেতরের সত্তার তুমি যখন পরিচয় লাভ করবে, তখন যে সময়সীমার মধ্যে তুমি তোমার চাহিদা পূরণ করতে চাইছ, তা তুমি সহজেই জয় করে নিতে পারবে। এ জন্য কতকগুলো বিশেষ কৌশল আছে, যেগুলো তোমার লক্ষ্য পূরণ করতে সাহায্য করবে। মনে রাখবে, এই প্রত্যেকটি কৌশলই কিন্তু তোমার নিজের আয়ত্তের মধ্যেই আছে। জীবনে সফলতা অর্জনকারী লোকেরা জীবনপথের কোনো-এক সময়ে কিভাবে নিজের জীবন কাটাবে সেই ঠিকানা খুঁজে পায়। যত কম বয়সে তুমি এই শক্তিশালী ক্ষমতার সন্ধান পাবে, তুমি তত সাফল্য এবং সুখের সাথে তোমার জীবন কাটাতে পারবে। তবে অনেকে জীবনের অনেকটা সময় পার করে দিয়েও অন্যকে দেখে নিজেদের জীবনের মোড় পরিবর্তন করে এবং সুখে জীবন কাটায় অথবা তাদের পছন্দমতো জীবন কাটায়। পরম করুণাময় ঈশ্বর মানুষকে তার মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছেন। প্রতিটি মানুষ যাতে নিজের মতো করে ভাবনা-চিন্তা করতে পারে, নিজের মতো করে জীবন কাটাতে পারে, লক্ষ্যপথে অগ্রসর বা লক্ষ্য পূরণ করতে পারে, তার জন্য সৃষ্টিকর্তা মানুষকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তুমি ইচ্ছে করলেই তোমার ভেতরের এই আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তি বা ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘মানসিক শান্তি’ লাভ করতে পারো। কোনো মানুষকে প্রকৃত সুখী হতে হলে এই জিনিসটা খুবই জরুরি। যে লোক যত সফলই হোক না কেন, তাঁদের জীবনেও কোনো-এক সময় হতাশা, ব্যর্থতা, হতোদ্যম ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। কারণ এগুলো বাদ দিয়ে কখনো জীবনে সফলতা আসতে পারে না। তুমি যদি তোমার অন্তরের সত্তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠো, তাহলে তুমি লক্ষ্য করতে পারবে যে, সেখানে হতাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। একবার হয়তো তুমি ব্যর্থ হয়ে পরাজয় বরণ করলে কিন্তু পরক্ষণেই এমন একটা লাফ দিতে পারো যে, তুমি জয়যাত্রার শীর্ষে পৌঁছে যাবে। তোমাকে হয়তো দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হতে পারে কিন্তু তুমি সব সময়ই দেখতে পাবে যে, তোমার ফিরে আসার পথ সুরক্ষিত ও মসৃণ। আমি ১৯১০ সালে, ম্যানুয়েল এল. কুইসনের ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা হয়েছিলাম। আমি যে তাকে শুধু নম্রভাবে উপদেশ দিতাম তা নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাকে পরামর্শ দিতাম। ঝপরবহপব ড়ভ চবৎংড়হধষ অপযরবাবসবহঃ সম্পর্কে তাকে শিক্ষা দিতাম। ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন সেনর কুইসন। ১৯১০ সালে ফিলিপাইন স্বাধীনতা লাভ করেছিল। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে কুইসনের মন সব সময় এই চিন্তায়ই আচ্ছন্ন ছিল যে, কেমন করে তিনি তার দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে পারবেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি নিজেকে একটা স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি বলে মনে করতেন। আমি সব সময় তাকে এ কথা বলে আশ্বস্ত করতাম যে, একদিন তার এই ইচ্ছা পূর্ণ হবেই। অবশ্য আমরা জানি এই ঘটনা রাতারাতি ঘটে যায় না। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাওয়ার জন্য আমাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে। অথচ আমাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক লোকই সেই শক্তি সম্পর্কে সচেতন রয়েছে। কিভাবে এই শক্তিকে বাড়ানো ও জাগ্রত করা যায় যে বিষয়ে অধিকাংশ লোকেরই কোনো ধারণা নেই। সেনর কুইসনকে পরামর্শ দানের সময় আমি তাকে বলে রেখেছিলাম যে, তিনি একটা কথা ভাবার জন্য যেন প্রতিদিন কিছুটা সময় আলাদা ও নির্দিষ্ট করে রাখেন। সেই নিবিষ্ট মনে ও একাগ্রচিত্তে ভাবনাটি হলো, তিনি একদিন অবশ্যই তার দেশবাসীকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি দেবেন। আমার নির্দেশানুযায়ী তিনি প্রত্যেক দিন, একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই কর্মটির পুনরাবৃত্তি করে যেতেন। ‘আমি কোনো লোকের মতামত বা সমালোচনা গ্রাহ্য করব না। আমাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে, এমন কোনো প্রভাব আমার মনের মধ্যে প্রবেশ করতে দেব না।’ প্রতিদিন দৃঢ়চিত্তে, দৃঢ় সংকল্পের সাথে একথা ভাবার ফলে তার মন যেমন দৃঢ়তা লাভ করেছিল, তেমনই তিনি পরবর্তী জীবনের যথেষ্ট তৎপরতার সাথে নানারকম সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম ও সফল হয়েছিলেন। সমস্ত প্রকার সাফল্য ও প্রাপ্তি আপনার চিন্তা ও কর্মদক্ষতার ফসল। আপনি যা ভাবেন, যা করেন, যেভাবে ভাবেন এবং করেন, যা বিশ্বাস করেন এবং কাজে লাগান, আপনার সাফল্যের পরিধি তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সফলতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন এবং কাজে মনোযোগী হোন, অবশ্যই সফল হবেন। আপনার সাফল্যকে কেউ আটকাতে পারবে না। ডেল কার্নেগির ‘চিন্তাশক্তির বিকাশসমগ্র’ বিষয়ক গ্রন্থসমূহ আপনার চলার পথকে সাফল্যের অগ্রযাত্রায় নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।