মধ্যযুগ ও আধুনিক কালের বাঙলা সাহিত্য বিষয়ক অসংখ্য ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হলেও সেই দীর্ঘ তালিকায় যাকে বলে ‘পূর্ণাঙ্গ’ ইতিহাস তার অনুপস্থিতি ছিল দীর্ঘদিন। কলকাতার ইতিহাসকারগণ মুসলমান লেখকের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। অন্যদিকে ঢাকার ইতিহাসকাররা শ্রমসাধ্য এ কাজে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসা ও জ্ঞান নিয়ে আত্মনিয়োগে করেননি। ফলে বাঙালীর ও বাঙলা সাহিত্যের শত ইতিহাসের ভিড়েও মেলে না ইতিহাসের কোনো পূর্ণ অবয়ব। এ কারণেই মধ্যযুগের কবি ও কাব্যের পরিচিতিমূলক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তাঁর সেই অপূর্ণ স্বপ্ন শুধু পূর্ণই করেননি, আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরি ড. আহমদ শরীফ। দুই খণ্ডের বৃহৎ কলেবরে রচনা করেছেন বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য। এ গ্রন্থে তিনি বাঙালীর রচনায় জাতির চিত্ত ও চরিত্রের যে প্রকাশ ঘটেছে, তাই প্রধানত জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছেন। আর তা করতে গিয়ে কোনো বাঙালীর রচনাকে তিনি তুচ্ছ করেননি। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা ও গবেষণার ফলে যে জ্ঞান, তত্ত্ব, প্রজ্ঞা ও বোধি তিনি অর্জন করেছেন তার স্বাক্ষর এ গ্রন্থের পাতায় পাতায়। বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য ড. আহমদ শরীফের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাঙলী সাহিত্যের ইতিহাসের অদ্বিভীয় আকরগ্রন্থ। বিনিষ্ট পাঠক ও নতুন ইতিহাস প্রণেতাদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। গ্রন্থটির দুই খণ্ড প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৯৭৮ ও ১৯৮৩ সালে। চার দশক পর প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হচ্ছে কালজয়ী এ গ্রন্থের অখণ্ড সংস্করণ।
বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার অনন্য ব্যক্তিত্ব এবং মধ্যযুগের সাহিত্য ও ইতিহাসের বিদগ্ধ পণ্ডিত ড. আহমদ শরীফ পঞ্চাশ দশক থেকে নিয়মিতভাবে প্ৰবন্ধ লেখা শুরু করেছিলেন এবং তা তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলমান ছিল। ড. আহমদ শরীফ এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাকে উপেক্ষা করা যায় তবে কোনো অবস্থাতেই তাঁর বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না । নিজস্ব দর্শন চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে বোদ্ধা সমাজের কাছে তিনি ছিলেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও এ ধারা বহমান। ভাববাদ মানবতাবাদ ও মার্কসবাদের যৌগিক ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণে, বক্তব্য ও লেখনীতে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণাকর্ম, সহস্রাধিক প্ৰবন্ধ তাকে কিংবদন্তী পণ্ডিত হিশেবে উভয় বঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১; গ্রাম সুচক্রদণ্ডী, উপজেলা পটিয়া, জেলা চট্টগ্রাম। পিতা আব্দুল আজিজ, মাতা সিরাজ খাতুন। প্রথম স্কুল চট্টগ্রাম শহরের আলকরণ মিউনিসিপ্যাল প্ৰাথমিক বিদ্যালয়। প্রবেশিকা পাশ করেন পটিয়া হাই স্কুল থেকে, আর আইএ, এবং বিএ পাশ করেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে, এবং এমএ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । ১৯৬৭ সালে ডক্টরেট উপাধি লাভ, বিষয়: সৈয়দ সুলতান, তার যুগ ও গ্রন্থাবলী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । মৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ ৷৷