আকাশে অনেক ঘুড়ি স্বনামে প্রকাশিত সুচরিত চৌধুরীর প্রথম গ্রন্থ ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’ সাতটি গল্পের এক অনন্য সংকলন। জলসীমা প্রকাশনী থেকে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন জহির। গ্রন্থটি ছাপা হয় সৈয়দ মো: শফির তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের আর্ট প্রেস থেকে। সমকালের আলোচিত গল্পগ্রন্থ ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’ পরবর্তী সময়েও সমভাবে আদৃত হয়েছে। অসামান্য রচনা, দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ ও মার্জিত মুদ্রণ এই পাঠকপ্রিয়তার কারণ। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’ ও শেষ গল্প ‘টুল-বেঞ্চের দিনগুলি’ বাংলা কিশোর সাহিত্যে অনন্য সংযোজন। প্রথম গল্পে একটা ঘুড়ির খোঁজে কিশোর মনের স্বপ্নযাত্রার বর্ণিল বয়ানের শেষে বাবুর করুণ পরিণতির অসাধারণ প্রতীকী উপস্থাপন : ‘ঘুড়িটা সাদা, কিন্তু লাল’– পাঠক মনকে আবিষ্ট করে রাখে। শেষ গল্প ‘টুল-বেঞ্চের দিনগুলি’ পড়তে পড়তে পাঠক খুঁজে পায় নিজের স্কুল জীবনের ফেলে আসা স্মৃতির কৌটো। ‘সুরতারা’ গল্পটি পড়লে বুঝা যায়, সংগীতের বিচিত্র ভুবনে লেখকের বিচরণ কতোটা অবাধ ও গভীর। মূলত গ্রন্থের প্রতিটি গল্পই কোনো না কোনো ভাবে পাঠক হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে। বিষয়ের বৈচিত্র ও প্রকাশভঙ্গির লালিত্য গল্পগুলোর প্রাণ। জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের দক্ষতা আর অপরূপ ভাষাশৈলীর প্রয়োগ গল্পকার সুচরিত চৌধুরীকে আলাদা করে চেনায়। গ্রন্থের বর্ণিল ও অর্থবহ প্রচ্ছদটি এঁকেছেন লেখকের সুহৃদ জহিরউদ্দিন খান। ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’ এখন দুষ্প্রাপ্য। বইটির গুরুত্ব বিবেচনা করে এ কালের পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই এই দ্বিতীয় প্রকাশের আয়োজন। দ্বিতীয় মুদ্রণে পূর্বের প্রচ্ছদ হুবহু রাখার প্রয়াস করা হয়েছে। আর গল্পগুলোর বানানের ক্ষেত্রে কিছু অপরিহার্য পরিবর্তন ব্যতীত লেখকের বানান রীতি অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞ সুচরিত চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালের ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল গ্রামে। তাঁর পিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসাহিত্য সংগ্রাহক দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী কবি-কণ্ঠহার আশুতোষ চৌধুরী, আর মাতা চারুবালা চৌধুরী, স্ত্রী মীরা চৌধুরী ও পুত্র সৌভিক চৌধুরী। গল্পকার হিসেবে সুচরিত চৌধুরী’র পরিচিতি সমধিক হলেও তিনি লিখেছেন উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গান। তিনি শুধু চৌধুরী ও সুরাইয়া চৌধুরী ছদ্মনামে কবিতা-গল্প লিখেছেন। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শুধু চৌধুরীর শুধু কবিতা’। প্রথম গ্রল্পগ্রন্থ ‘সুরাইয়া চৌধুরীর সেরা গল্প’ প্রকাশ পায় ১৯৫২ সালে। স্বনামে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। তাঁর অন্যান্য বইগুলো হলো– ‘একদিন একরাত’ (গল্প, ১৯৬৬), ‘সুচরিত চৌধুরীর নির্বাচিত গল্প’ (১৯৮৭), ‘নদী নির্জন নীল’ (উপন্যাস, ১৯৮৭), ‘কিংবদন্তীর গল্প : চট্টগ্রাম’ (১৯৯৩), ‘ঋতু’ (কিশোর উপন্যাস, ২০০৯), ‘সুচরিত চৌধুরীর রচনা সংগ্রহ’ (২০১১)। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সাথে তিনি যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেন সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা ‘সীমান্ত’। এছাড়া সিনে মাসিক ‘উদয়ন’, সাপ্তাহিক ‘রেনেসাঁ’, সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রাচী’, ‘দিগন্ত’ও সম্পাদনা করেছেন তিনি। রচনা করেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ ও সংগীত বিষয়ক নিবন্ধ। সুচরিত চৌধুরী ছিলেন একজন বিশিষ্ট সংগীত-সাধক। বংশীবাদনে অনায়াস দক্ষতা প্রমাণ করেছে রাগ-রাগিনীর ভুবনে তাঁর অবাধ পদচারণা। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গানের বই স্বরলিপিযুক্ত ‘সুর লেখা’। এছাড়াও তিনি রচনা করেছেন প্রায় তিন হাজার গান। সুচরিত চৌধুরী রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক হলো– ‘পার্কের কোণ থেকে’, ‘একজন শহীদ’, ‘সুতরাং’। তাঁর পিতা আশুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত ‘নছর মালুম’ পালার নৃত্যনাট্যরূপ ‘আমিনা সোন্দরী’তে (১৯৭৬) সুরারোপ ও সংগীত পরিচালনা সুচরিত চৌধুরীর অন্যতম কীর্তি। এই ‘আমিনা সোন্দরী’ পালার শেষ মঞ্চায়ন হয়েছে ২০১২ সালে। ১৯৭৬ সালে সুচরিত চৌধুরী ছোটগল্পে অবদানের জন্য লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৯৪ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন।