লোকশিল্পীর ও লোকসংগীতের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে লোকায়ত জ্ঞান। এই জ্ঞানের সংরক্ষণ ও গুরুত্বকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সুমনকুমার দাশের রয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা। তিনি গ্রামীণ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনযাপনকে নাগরিক সমাজে নিরন্তর পরিচয় করিয়ে চলেছেন। মেলা, উৎসব, ওরস, মাজার, মন্দির, শ্মশান, ফকিরের ডেরা, বাউলের আখড়া আর গ্রামীণ জনপদ ঘুরে তিনি আমাদের প্রান্তবাসী সাধকদের অচেনা ভুবনের আশ্চর্য ও কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাগুলো নিজের লেখায় এনেছেন। মরমিসাধকদের জীবনযাপন আর পরিবেশনারীতি প্রত্যক্ষ করে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সাংস্কৃতিক জীবনধারা তিনি উন্মোচন করে চলেছেন। প্রায় আড়াই দশক ধরে সুমনকুমার দাশ বাংলাদেশের বাউল, ফকির, মারফতি মতের সাধক ও লোকশিল্পীদের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লোকসম্ভারের প্রধান জায়গা হাওরে বড় হয়েছেন তিনি। ভাটির দেশকে দেখেছেন দুচোখ ভরে। সঙ্গ পেয়েছেন ভাটির উল্লেখযোগ্য সব মরমিয়াদের। দেখেছেন তাঁদের সুখ, দুঃখ, সাধক জীবন। যে জীবনের পরতে পরতে রয়েছে সাধনতত্তে¡র গান, আদতে তিনি মরমিয়াদের এক গূঢ় রোমন্থন করেছেন তাঁর লেখাগুলোতে। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বই ৭১টি। এর মধ্যে ১২ খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বাউল-ফকির পদাবলি’ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদিত কাজ। ‘দইয়ল’ নামে একটা গানের কাগজ সম্পাদনাও করছেন। এ ছাড়া ‘কেওড়ালি’ নামে সাহিত্যের একটা ছোটকাগজও একসময় সম্পাদনা করতেন। সুমনকুমার দাশের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘লোকায়ত জীবন ও লোকসাহিত্য’, ‘বাউলগানে বঙ্গবন্ধু’, ‘বাউলের আখড়ায় ফকিরের ডেরায়’, ‘বাংলাদেশের বাউল ফকির লোকশিল্পী’, ‘বাউলকোষ’, ‘লোকসাধক লোকসংস্কৃতি’ ‘বাংলাদেশের বাউল-ফকির : পরিচিতি ও গান’, ‘লোকগানের বিচিত্র ধারা’, ‘গান থেকে গানে’, ‘লোকগান লোকসংস্কৃতি’, ‘শাহ আবদুল করিম : জীবন ও গান’, ‘বাংলাদেশের ধামাইল গান’, ‘লোকায়ত বাংলার পথ ধরে’, ‘চৌদ্দভুবন : চৌদ্দজন দেহসাধকের জীবন ও দর্শন’, ‘ধীরপায়ে ধূলিপথে’, ‘লোকসাধকের দরবারে’, ‘রামকানাইদাশের নন্দনভুবন : অন্তরঙ্গ আলাপ’, ‘লোকভাবন’, ‘বেদে-সংগীত’, ‘বাউলসাধনা, লালন সাঁই ও অন্যান্য’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নাল ও সাময়িকীতে ফোকলোর বিষয়ে তাঁর অন্তত দুই শতাধিক প্রবন্ধ ও ক্ষেত্রসমীক্ষা-গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা পদক, সুনামগঞ্জ (২০২২), মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, চাঁদপুর (২০২৩)-সহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু পুরস্কার পেয়েছেন। ফোকলোরে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩-এ তিনি সম্প্রতি ভূষিত হন।
ফোকলোর-গবেষক, সংগ্রাহক। জন্ম: সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সুখলাইন গ্রামে, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮২। পিতা বারীন্দ্রকুমার দাশ, মা যমুনা বালা চৌধুরী। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। প্রায় আড়াই দশক ধরে সিলেট শহরের বাসিন্দা। শিক্ষা: স্নাতক (সম্মান)। পেশা: সাংবাদিকতা। তবে প্রাকৃতজনদের আচার, কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। বাংলার ফোকলোর-গবেষণা যাঁদের হাত ধরে সমৃদ্ধ ও প্রাণবান হয়েছে, এঁদের মধ্যে সুমনকুমার দাশ অগ্রগণ্য। তিনি নীরবে-নিভৃতে বাংলার নিজস্ব দর্শনের ধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন। তাঁর আগ্রহ ও চর্চার প্রধান বিষয় ফোকলোরের লোকজীবন, জনপদ, লোকসংগীত ও লোকশিল্পী। গ্রামাঞ্চল ঘুরে প্রাচীন ও বিলুপ্তপ্রায় গান সংগ্রহ করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী বিচিত্র সব গানের ধারার আসরে সরেজমিনে গিয়েছেন, মিশেছেন লোকশিল্পীদের সঙ্গে, দেখেছেন লোকজীবন। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে নানা ধারা-উপধারার অন্তত ৭০ হাজার লোকগান, লোকনাট্য ও পাঁচালি রয়েছে। বেদে-বাইদ্যানির গান, ভিক্ষুক-সংগীত, ধামাইলগান, জারি-মার্সিয়া, পল্লিগীতি, মাজার-সংগীত, ঢপযাত্রা প্রভৃতি বিষয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন লোকগবেষণার আঙিনাকে।