এক জং ধরা পুরনো মুড়ির টিনের মত শেষ বগিটা এক পাক ধুলি বাতাস উড়িয়ে উধাও হয়ে গেল। কিছু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাকিব হাসান। এই তাহলে কথিত রেল স্টেশন যার অদূরে তার কর্মস্থল! চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জায়গাটাকে এক পাক দেখে নিল সে। ছোট্ট, জড়াজীর্ণ। আশপাশে ঘরবাড়ি নেই। উত্তর পাশের ছোট ছোট চালাঘরগুলো সম্ভবত কাঁচা বাজারের দোকান ঘর। গোটা দুই চায়ের একজনও ক্রেতা নেই। এতরাতে ক্রেতা থাকবে কোত্থেকে? শীতের রাত হলে কথা ছিল। সে পা বাড়াতে গিয়ে দেখল বেশ নোংরাও জায়গাটা। কলার খোসা, বাদামের খোলস, ছেঁড়া ঠোঙা, মুরগীর পালক, মরা-ঝড়া পাতা দেদারছে পড়ে আছে। ক্লিনার নেই কিংবা থাকলেও কর্তব্য কাজের তদারকি নেই বুঝি। এক জোড়া কুকুর পাশাপাশি বসে সম্ভবত কিছু ভাবছিল গভীর মনে। যেদিকে মুখ করে সে দাঁড়িয়েছিল সেদিকেই হাত দুই এগিয়ে সে থমকে দাঁড়ালো। কোথায় যাবে সে? কোন্ দিকে? কাকে জিজ্ঞাসা করবে জায়গাটা কোন্ দিকে? যে ক’জন লোক তার সাথে ট্রেন থেকে নেমেছিল, সম্ভবত তারা স্থানীয় হবেন; দেখতে দেখতেই কোথায় কোন্ দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। হাত ঘড়িতে দৃষ্টি দিল সে। রাত সাড়ে তিনটা। চায়ের স্টলওয়ালা লোক দু’জন কিসের আশায় ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছে। আর কিছু না ভেবে তাদের দিকেই গন্তব্যস্থলের ঠিকানা লেখা কাগজটা মেলে ধরল সে। তাদের একজন কোন উচ্চবাচ্য না করে কিছুদূর তার সাথে এগিয়ে এসে তার গন্তব্যের পথে তুলে দিয়ে গেল তাকে। এখান থেকে মিনিট পনেরর পথ। গন্তব্যে পৌঁছতে পা দুটোই একমাত্র বাহন। স্টেশন আলোর বিক্ষেপণে এতক্ষণ সে আকাশ দেখেনি। পথে পা ফেলতেই চাঁদের আলো তার চোখ দুটোকে উর্ধ্বে টেনে নিয়ে গেল। এবারে সে মাথার ওপরকার মায়াবি ফুলেল আকাশটা দেখতে পেল। অগণিত ঘাসফুল ঘেরা একটা অসম সূর্যমূখী যেন আলো ঢেলে দিয়ে পৃথিবীকে ঋণী করে চলেছে। সে-ও নিজেকে ঋণী ভাবতে লাগলো। তার সঙ্গে কোন টর্চ, দেশলাই-কিছু নেই। চাঁদটা জেগে না থাকলে এ অচেনা পথে অন্ধকারে কী অসুবিধাই না হত! সে যে পথ ধরে চলেছে সেটা কাঁচা সড়ক পথ। তার দু’পাশে প্রায়ই বড়সড় রকমের পুকুর চোখে পড়ছে। অন্যত্র অনুচ্চ ঘন ঝোপময় গাছগুলো সম্ভবত ঢোল-কলমী, ধূতুরার। মৃদু চোপসানো ফুলগুলো মৃদু মৃদু দুলে শেষ রাতের চাঁদটিকে বুঝি বিদায় সম্ভাষণ দিচ্ছে। কোন পাখি, জীবজন্তুর সাড়াশব্দ নেই ; না আছে ঝিঁঝিঁর ডাক। এমন শান্ত পৃথিবী তার আগে দেখা হয়নি। মনে মৃদু ভয় জাগলেও অদূরে দেখা যাওয়া একতলা ভবনের অবয়ব নিমিষে তা ঘুচিয়ে দিল। বোধ করি ওটাই তার গন্তব্যস্থল, কর্মস্থল। ওখানেই শুরু হবে তার প্রথম কর্মজীবন। ভেতরে বেশ রোমাঞ্চ শুরু হয়ে গেল তার। রাস্তার বাঁক ঘুরে একতলা ভবনটার সম্মুখ দিকে চলে এলো সে। একটাই ভবন-বাংলো টাইপ। সামনের খোলা মাঠ বিস্তৃত হয়েছে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে। ত্রিভূজাকার মাঠকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ঘন গাছগাছালি। আম, কাঁঠাল, লিচুর মাঝে মাঝে উর্ধ্বে উঠে গেছে নারকেলের চূড়া। তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল অসম গোল চাঁদটি। চারদিকে তাকিয়ে প্রাণটা ভরে উঠলো তার। আবছায়ায় সে দেখতে পেল বাংলোর দরজায় তালা। কেউ তার অপেক্ষায় নেই; থাকার কথাও নয়। তার আসার কথা ছিল সকালের ট্রেনে।
শওকত নূর লেখক পরিচিতি: শওকত নূর কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন দীর্ঘদিন। গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি পত্র পত্রিকায় লিখছেন নিয়মিত। আলােচিত উপন্যাস নিঃস্তব্ধ অন্ধকার’ এর মধ্য দিয়ে গ্রন্থে আত্মপ্রকাশ। অন্যান্য পাঠকপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে রাত্রি শেষে, নূপুর, তৃষ্ণার সাথে, স্বপ্ন দেখা ভাের, অপেক্ষমাণ, সেই শেষ দেখা, গােধূলির কথা, অশ্রু প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। গল্পগ্রন্থ বিতৃষ্ণা, শেষ কথা, ছায়া মানুষ, এক সন্ধ্যার ভালােবাসা, বন্ধু, নতুন জীবন, শুভরাত্রি প্রভৃতি সমধিক জনপ্রিয়। ছােটোদের জন্যও তিনি লিখে যাচ্ছেন নানা আঙ্গিকে। কিশােরগল্প পাগলা দাদার কাণ্ড, ভুলু মাস্টারের ভূতের স্কুল, ভূতের ডাক্তার, ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, তিন উন্মাদের গল্প, রাখাল, বাঘা, টপু ও এক ঝক দেশি পেঁচা, ছড়াগ্রন্থ ডাবলু মামা ও হাবলু গামা, হুক্কাহুয়া, চাঁদের দেশে প্রভৃতি বহুলপঠিত। ‘ধূসর নীল সমুদ্রে’ গল্পগ্রন্থে তিনি হাজির হয়েছেন একগুচ্ছ অনন্য সাধারণ গল্প নিয়ে।। কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার শওকত নূর এর জন্ম টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার হাতিয়া গ্রামে। জন্ম তারিখ ৭ মার্চ ১৯৭০। তিনি পড়াশােনা করেছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পেশা শিক্ষকতা ও লেখালেখি। কর্মস্থল রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ইনজিনিয়ারিং ইউনিভারসিটি স্কুল এন্ড কলেজ।