কান্না যখনই দৃষ্টি সীমায় আসে, দেখি লোকটি কাঁদে। শুধুই কাঁদে। কাঁদে বলতে ঠোঁট চেপে মুখাবয়বে কারুণ্য ফুটিয়ে নীরব অশ্রু বিসর্জনে নয়। সে কাঁদে রীতিমত দু’হাতে বুক চাপড়ে, মুখ হা-করে, উ-হু-হু ধরনের উৎকট শব্দ করে করে। প্রায় আমি তার এ কান্না নিয়ে খুব ব্যথিত বা কৌতূহলী হই। মনে মনে এ হেন হৃদবিদীর্ণকারী কান্নার কারণ জানতে মরিয়া হই। কিন্তু আশপাশের কাউকেই যেহেতু এ বিষয়ে ন্যুনতম বিচলিত হতে কিংবা টু’ শব্দটি করতে দেখি না, আমার অদৃশ্য কৌতূহল উৎকণ্ঠা অদৃশ্যলোকেই চাপা পড়ে যায়। লোকটি আমাকে অতিক্রম করে যাওয়া মাত্রই তাই যথারীতি কাজে মনোনিবেশ করি। আনমনে মন থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস করি ওই সব হৃদ-সঞ্চালক বিষয়াদি। ভ‚লে যাওয়াই মানুষের ধর্ম; তাই কসরৎ সাপেক্ষে তাতে ক্ষণিক সফলও হই। আমি শহরস্থ এক মুদি দোকানের কর্মচারী, একমাত্র বিক্রেতা তথা দোকান রক্ষক। শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়কে দোকানের অবস্থিতি। দোকানের ঝাঁপ তুলে বেচা বিক্রি উদ্দেশ্যে মেঝেতে দাঁড়ালেই সম্মুখ পথটিতে নিত্য চোখ চলে যায়। ভোরবেলা দোকান খুলে ঘড়িতে দম দিয়ে দাঁড়ালেই দেখি কথিত লোকটি একই ভঙ্গিমায় কেঁদেকেটে আশপাশের বাতাসকে ভারী করে দিয়ে মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। একই দৃশ্য চোখে পড়ে প্রতি রাতে যখন বেচা বিক্রি সাঙ্গ করে ঘরে ফিরতে যাব তখন। লোকটাও হয়তো তখন ফেরে। ঠিক একই ভঙ্গিমায় আকাশ বাতাস আরও বেশি ভারী করে ফেরে। আমি সারাদিনের ক্লান্ত অবসন্ন। মনে খুব ঘোর লেগে যায়। ঘোর নিয়ে ঘরে ফিরি, খাই, ঘুমাই।পরবর্তী ভোরে একই ঘোরকে নতুন করে বরণ করি। লোকটার বয়স পয়তাল্লিশ কিংবা তদূর্ধ্ব। উচ্চতা বেশ, গড়ন ছিপছিপে, গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, মাথার চুল দেখার মত ছোট, পরনের পোশাক অনাঢ়ম্বর আটপৌড়ে। তার চলার গতি ধীর এবং সমবেগসম্পন্ন। রাতে দোকানের ঝাপ ফেলে যখন বার তালায় চাবি দিই তখন সে মেইন পথ পেরিয়ে উপপথ ধরে ধীরে অদৃশ্য হয়। শুনতে থাকা কান্নাটা আচমকা অশ্রæত হয়। ভাবি, হয়তো উপপথের অনতিদূরেই তার বাস। আগেই বলেছি, তার রেখে যাওয়া কান্নার ঘোরে ফিরতি পথ চলা থেকে শুরু করে ঘুম নাগাদ অবতীর্ণ হই-অভিন্ন পবিক্রমায় দিন রাত্রি চলে। কিন্তু এক ভোরে দোকানে উপস্থিত হবার পর খানিকটা ব্যতিক্রম সূচিত হয়।
শওকত নূর লেখক পরিচিতি: শওকত নূর কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন দীর্ঘদিন। গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি পত্র পত্রিকায় লিখছেন নিয়মিত। আলােচিত উপন্যাস নিঃস্তব্ধ অন্ধকার’ এর মধ্য দিয়ে গ্রন্থে আত্মপ্রকাশ। অন্যান্য পাঠকপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে রাত্রি শেষে, নূপুর, তৃষ্ণার সাথে, স্বপ্ন দেখা ভাের, অপেক্ষমাণ, সেই শেষ দেখা, গােধূলির কথা, অশ্রু প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। গল্পগ্রন্থ বিতৃষ্ণা, শেষ কথা, ছায়া মানুষ, এক সন্ধ্যার ভালােবাসা, বন্ধু, নতুন জীবন, শুভরাত্রি প্রভৃতি সমধিক জনপ্রিয়। ছােটোদের জন্যও তিনি লিখে যাচ্ছেন নানা আঙ্গিকে। কিশােরগল্প পাগলা দাদার কাণ্ড, ভুলু মাস্টারের ভূতের স্কুল, ভূতের ডাক্তার, ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, তিন উন্মাদের গল্প, রাখাল, বাঘা, টপু ও এক ঝক দেশি পেঁচা, ছড়াগ্রন্থ ডাবলু মামা ও হাবলু গামা, হুক্কাহুয়া, চাঁদের দেশে প্রভৃতি বহুলপঠিত। ‘ধূসর নীল সমুদ্রে’ গল্পগ্রন্থে তিনি হাজির হয়েছেন একগুচ্ছ অনন্য সাধারণ গল্প নিয়ে।। কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার শওকত নূর এর জন্ম টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার হাতিয়া গ্রামে। জন্ম তারিখ ৭ মার্চ ১৯৭০। তিনি পড়াশােনা করেছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পেশা শিক্ষকতা ও লেখালেখি। কর্মস্থল রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ইনজিনিয়ারিং ইউনিভারসিটি স্কুল এন্ড কলেজ।