হাঁসজারু, বকচ্ছপ, গিরগিটিয়া, হাতিমি, বিছাগল... বাংলা ভাষায় ছোটদের বই যারা খানিকটা হলেও নেড়েচেড়ে দেখেন, এই চরিত্রগুলো তাদের ভীষণই প্রিয়, ভীষণই চেনা। তবু যদি অচেনা লাগে, তাহলে ছড়াটাই মনে করিয়ে দিতে হয়- হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না), হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না হ্যাঁ, এইসব অদ্ভূতুড়ে শঙ্কর প্রাণীগুলো- হাঁসজারু, বকচ্ছপ, গিরগিটিয়া, হাতিমি, বিছাগল- সব সুকুমার রায়ের অনন্য সৃষ্টি।ছড়াটির নামটিও জুতসই—‘খিচুড়ি’। ছবিসহ এই ছড়া প্রথম ছেপেছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। পরে যেই ছড়ার বইটিতে এই ছড়ার স্থান হয়, সেটিও ভীষণই বিখ্যাত। নাম ‘আবোল তাবোল’। ‘আবোল তাবোল’ নামের সুকুমার রায়ের এই বইটা এমনি সব আবোল তাবোল ছড়ায় ভরা। আজগুবি আর মজার মজার সব ছড়া। এই যেমন ‘কাঠবুড়ো’ ছড়াটা। ছড়ার শুরুতেই কাঠবুড়োর যে বর্ণনা দিয়েছেন সুকুমার, শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাওয়ার কথা- হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে যেন কে বৃদ্ধ, রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ। শুধু কাঠ চেটেই ক্ষান্ত নয় বুড়ো, কাঠে কেন গর্ত হয়, তাই নিয়ে ভেবে ভেবে তার ‘টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম’। আবার ‘কি মুস্কিল’ ছড়াতে আছে এক আজব সমস্যার কথা। এক লোকের কাছে আছে এমন এক কেতাব, তাতে দুনিয়ার সব খবরই আছে। তাও কিন্তু তার একটা সমস্যা থেকেই গেছে। কেন?- সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায়- পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন করে ঠেকাব তায়! সারাদিন এ বই সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েও শেষ করা যাবে না। এক কথায় অসাধারণ। বইটাতে সুকুমার রায় কেবল ছড়া লিখেই ক্ষান্ত দেননি, প্রত্যেকটা ছড়ার সঙ্গে জুতসই ছবিও এঁকেছেন। এঁকেছেন হাঁসজারু আর গিরগিটিয়াদের ছবি, কাঠবুড়ো আর গোঁফ হারানো বড় বাবুর ছবি, হুঁকোমুখো হ্যাংলা আর ট্যাঁশ গরুর ছবি। আছে গোমড়ামুখো রামগড়ুরের ছানার ছবিও। ছবি আছে প্রত্যেকটা ছড়ার সাথেই। এই ছড়াগুলো সন্দেশে ছাপানোর সময় নিজ হাতে ছবিগুলো এঁকেছিলেন সুকুমার রায়।
উপেন্দ্ৰকিশোর রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ সুকুমারের জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০৬-এ পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন দুই বিষয়েই অনার্স নিয়ে বি.এসসি পাশ করার পর ১৯১১-য় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুপ্ৰসন্ন ঘোষ বৃত্তি লাভ করে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি বিলেতে যান। লন্ডনে ও ম্যাঞ্চেস্টারে অধ্যয়ন করেন তিনি ও তাঁর গবেষণার জন্য সম্মানিত হন। ১৯১৩-য় উপেন্দ্ৰকিশোরের সম্পাদনায় ছোটদের সচিত্ৰ মাসিক পত্রিকা সন্দেশ’’ প্রকাশিত হয়। সুকুমার দেশে ফেরারী কিছুকাল পরে ১৯১৫-য় উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। সুকুমার ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কার্যালয়ের পরিচালনার এবং “সন্দেশ’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন। “সন্দেশ’-এর পাতাতেই তাঁর অধিকাংশ ছোটদের লেখা-গল্প, কবিতা, প্ৰবন্ধ, ধাঁধা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। শুধু নিজের লেখা নয়, ছবি এঁকেছেন তিনি। “হ য ব র ল’, ‘আবোল তাবোল’ জাতীয় আজগুবি চালের বেঠিক বেতাল ভুলের ভবের গদ্য ও পদ্য রচনা ছাড়াও শিল্প সাহিত্য ভাষা ধর্ম বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সক্রিয় ছিল তাঁর লেখনী। আড়াই বছর কালাজ্বরে ভুগে ১৯২৩-এ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সুকুমার রায় ১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি শুয়ে শুয়ে সন্দেশের জন্য ছবি এঁকেছেন, প্রচ্ছদ রচনা করেছেন, গল্প কবিতা লিখেছেন। আবোল তাবোল’-এর ডামি কপিাটাও রোগশয্যায় তৈরি করেছেন। কিন্তু বইটি ছেপে বেরোবার ন” দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়।