অমর যত্নের অনিন্দ্য উচ্ছ্বাস আর খেতাবী বৈচিত্র্যের দোলায়িত ছায়াসঙ্গী হয়ে বাঙালি জীবনযাত্রার পরতে পরতে মৃদু হাসিতে পথ হেটেছেন যিনি। তিনি আমাদের অতি আপনজন-কবি আসাদ চৌধুরী। ত্রিশোত্তর গরিষ্ঠ আবিষ্কারের ক্লান্ত চোখে তিনি বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তুর হাত ধরে লঘিষ্ঠ রোশনাই জ্বেলেছেন অতি সন্তর্পনে। আমরা বাংলা কবিতায় বাঙালি সংস্কৃতির আলোকিত ধারক ও বাহক হিসেবে পেয়েছি তাঁকে। তবে তাঁর কবিতার খাতাজুড়ে রূপালি জ্যোৎস্নার আলপথ তৈরি করলেও তিনি প্রয়োজনের সওদায় গদ্য রচনায় ভেজা বিহঙ্গের সঙ্গে আত্মীয়তা করেছেন অনন্য ব্যঞ্জনায়। বাঙালি সংস্কৃতির লোকবিশ্বাস থেকে লোকসংস্কারে, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্যে, জাতীয়তাবোধের ঐক্য থেকে স্বাধীনতাকামী জনতার অব্যর্থ গন্তব্যের নিত্য লড়াইয়ের সারথী হয়ে আসাদ চৌধুরী গদ্যের চিত্রায়ন করেছেন অনবদ্য ভঙ্গিমায়। আর তাই বলা চলে পরিকল্পনার ইপ্সিত ফলের ওমে আমরা তাঁর গদ্যসমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডে পেয়েছি সোনালি স্মৃতির তীক্ষ্ণ গাথা। গদ্যভারেপূর্ণ লেখকের সঙ্গে পাঠকের বিশ্লেষণাত্মক দুরত্বকে তিনি বাড়ন্ত অনুসন্ধানকালের ঔদার্যে নির্ণয় করেছেন অপরিমিতস্বরে। সংজ্ঞায়িত প্রসন্নতালাভের নিছক প্রয়াসে তিনি গদ্যকে ভারী নয়, বরং চর্চিত অর্ঘ্যের সরলতম রূপায়ণ করেছেন। আমরা তাঁর গদ্যসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড হাতে নিয়ে পাঠসংক্রমণে আসক্ত হবো, তাঁর লেখনীর সাবলীলতায় খুঁজে পাবো তেজোদ্দীপ্ত স্মৃতির সমাহার। গদ্যের পরম্পরায় স্বর্গীয় দৃষ্টান্তে স্নাত সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে আসাদ চৌধুরী পাঠ মেলাননি। তিনি পাঠ মিলিয়েছেন বিচ্ছিন্ন ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতায়পূর্ণ মানবমনের অসীম বাস্তবতায়। তাইতো লোকায়ত আর নাগরিকতায় তাঁর গদ্য পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে শেকল ভাঙার অসামান্য প্রতীক্ষা। যেখানে ডানা ঝাপটায় ব্যামোর পৃথিবীজয়ী সরল বিশ্বাসেপূর্ণ দখলী নিঃশ্বাস।
আসাদ চৌধুরী। জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, উলানিয়া, বরিশাল। বাংলাদেশের কবিতায় ‘তবক দেওয়া পান’ নিয়ে আসাদ চৌধুরীর আর্বিভাব। স্বল্পবাক, ঋজু এবং বক্তব্য প্রকাশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিকীর্ণ এই কবি, বাংলাদেশের ষাট দশকের কবিতায় সংযোজন করেছেন নতুন মাত্রা। এ মাত্রা লক্ষণীয় তাঁর ভাষা ও প্রকরণে; যেখানে তিনি ঐতিহ্য, শে¬ষ, প্রেম, সৌন্দর্য ও মরমি চেতনার সংমিশ্রণ ঘটান। আসাদ চৌধুরী, তাঁর কবিতায় মরমি-মানসিকতা নিয়ে বাঙালি জাতির ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করেছেন। আর তাই ছন্দে মেজাজে এবং বক্তব্যে তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় এক যুগ সময়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এবং জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। জার্মানির কোলনের ভয়েস অব জার্মানির বাংলা বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন (১৯৮৫-৮৮)। বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রায় ছাব্বিশ বছর। আসাদ চৌধুরী কবিতা আবৃত্তি করেন। বেতার টিভিতে উপস্থাপনা করেন। প্রচুর নাটক সিনেমা দেখেন। ভ্রমণ তার নেশা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোতেই তার আনন্দ। সব বয়সী পাঠকের জন্য কবিতা, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিশেষভাবে ছোটদের জন্য লিখেছেন ছড়া-কবিতা, রূপকথার গল্প, অনুবাদ এবং জীবনীগ্রন্থও। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (২০১৩) সহ অসংখ্য পুরস্কার। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণচঞ্চল চির তারুণ্যের প্রতীক আসাদ চৌধুরী ছোট বড় সকলেরই প্রিয় মানুুষ।