পুরুষতন্ত্র মতে, সকল উৎকৃষ্টের সমাহার হচ্ছে পুরুষ। সে সক্রিয়, উদ্যমী, কৌশলী, ধীমান, বলশালী, অকুতোভয়, নিয়ন্ত্রক, মহৎ, আধিপত্যকারী এবং আরো আরো বহু কিছু। এই ছক অনুসারে পুরুষ ভাবমূর্তি গড়া হয়েছে পুরুষের পুরাণে পুরাণে, রূপকথায়, মহাকাব্যে, লোকগাথায়, পুরুষরচিত অন্য সকল সাহিত্যে। নারীলেখক যখন পুরুষ গড়েন, তখন কেমন হয় তার রূপ? পুরুষতন্ত্র- নির্দেশিত পুরুষ ভাবমূর্তির ছক অনুসারেই কি তিনি গড়েন পুরুষকে? না, নিজের লুকোনো-চুরানো ভাবনা, সাধ-আক্ষেপ-স্বপ্ন মিশিয়ে দেন তিনি পুরুষতন্ত্রের ছাঁচের সঙ্গে! লক্ষ করা যায়, আমাদের নারীলেখকদের কেউ কেউ হচ্ছেন নির্ভুলরকম পুরুষতন্ত্রের নির্দেশ মান্যকারী। তাঁরা প্রথা মেনেই গড়েন তাঁদের নায়ক বা পুরুষ। আবার কেউ কেউ বাহ্যত থেকেছেন পুরুষতন্ত্রের ছক-অনুসারী, কিন্তু ভেতরে ভেতরে গড়ে চলেছেন তাঁর নিজস্ব ছাঁচের এক পুরুষ-নারীর পুরুষ। এ-পুরুষ পুরুষতন্ত্রের পৃথিবীর পুরুষের অবিকল প্রতিমূর্তি নয়। অন্যরকম একজন সে। তাকে গড়ার মধ্য দিয়ে নারী অনেকখানিই ব্যক্ত করে এবং মূর্ত করে তোলে তার 'অসম্ভবের জন্য বাসনা'র রূপটিকে। এ বইয়ে উদ্ঘাটন করা হয়েছে নারীর গড়া পুরুষ-ভাবমূর্তির স্বরূপ, আলোকপাত করা হয়েছে নারীলেখকের পুরুষভাবনার ওপর, ব্যাখ্যা করা হয়েছে নারীস্রষ্টার গড়া পুরুষের প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য, দেখানো হয়েছে বাস্তব পুরুষের চেয়ে কতোটা ভিন্ন সে। বিশ শতকের মধ্যভাগে এই ভাষা-অঞ্চলে রোমেনা আফাজ তাঁর রোমাঞ্চ- উপন্যাসগুলোতে গড়ে তুলতে থাকেন এমন এক পুরুষ, যে দস্যু, সমাজবহিরিস্থিত, আইনভঙ্গকারী, অথচ মহৎ এক ত্রাতা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে থাকে, নারীর গড়া একটি প্রধান চরিত্রমাত্র এই পুরুষটি। কিন্তু ওই পুরুষের গল্পগুলো ধারাবাহিকভাবে পড়ে উঠতে থাকলে আমাদের কাছে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যে, দস্যু বনহুর শুধু নারীর গড়া একজন পুরুষমাত্রই নয় বরং তার মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে নারীর নিরন্তর পুরুষভাবনাটিই। সমাজ ও প্রথার পেষণে বিকলাঙ্গ ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যেতে থাকা 'হয়ে ওঠার' বাসনাটিরও প্রকাশ ঘটে চলেছে এইখানে।
ইনডিপেন্ডেট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ-এ অধ্যাপনারত আকিমুন রহমান পিএইচ ডি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ; আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ, সােনার খড়কুটো, পাশে শুধু ছায়া ছিলাে, পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে, রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া এ মাছি, এইসব নিভৃত কুহক।