মোজাফফর আহমদ খান বাহাদুর সাহেব অনেকটা অস্থিরভাবেই বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। বসতে বসতেই আপনমনে বললেন- নাহ্ঃ, মেয়েটাকে নিয়ে আর পারলাম না। দিন দিন সে আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। শুনে খান সাহেবের ম্যানেজার কোরবান আলী মিয়া উৎসুককণ্ঠে বললেন- কার কথা বলছেন হুজুর? মোজাফফর আহমদ খান বাহাদুর সাহেব বিষণ্নকণ্ঠে বললেন- কার কথা আবার! আমার মেয়ে শবনম সাদিকার কথা বলছি। দিন দিন সে এতটা জেদী হয়ে উঠছে যে, তাকে আর কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। কথায় কথায় যা পাচ্ছে তাই ভাংচুর করছে। কোন যুক্তি তর্কের ধারে কাছে যাচ্ছে না। কোরবান আলী মিয়া দুঃখ করে বললেন- আহারে! এত ভাল মেয়ে- এত চমৎকার যার আদব আক্কেল আর এত মিষ্টি যার স্বভাব, সে দিন দিন বিগড়ে যাবে- এটা কেমন কথা? এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। ম্যানেজার কোরবান আলী মিয়া ঈমানদার ও এলেমদার মানুষ। বিষয়টি নিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন। মোজাফফর আহমদ খান বাহাদুর সাহেব হতাশকণ্ঠে বললেন- আর ছিল না। এখন ভাবছি, ইস্কুলে গিয়ে ইদানীং সে মেয়েদের সাথে কেমন আচরণ করছে? বন্য আচরণ করছে না তো? ছাত্রীদের জানপ্রাণ ঝালাপালা করে তুলছে না তো? : হুজুর! : ওদিকের খবর কিছু জানো কি? : জি হুজুর, জানি। মেয়েদের জান ঝালাপালা করে তুলবে কি, মেয়েরা তো শবনম ম্যাডাম বলতে অজ্ঞান। যতক্ষণ ম্যাডাম ক্লাসে না যায় ততক্ষণ মেয়েরা পথ চেয়ে থাকে। ম্যাডাম ক্লাসে গেলে তাদের খুশি দেখে কে? : সে কি কথা! শবনমকে তারা এখন সহ্য করতে পারে তো? : পারে মানে কি হুজুর! তাকে তো মেয়েরা ভাতে মাছে পায়। ছাত্রীরা তাদের ম্যাডামকে যেমন ভালোবাসে, ম্যাডামও ছাত্রীদেরকে তেমনই প্রাণ ঢেলে ভালোবাসে। একদিন কোন কারণে আমাদের শবনম আম্মা স্কুলে না গেলে স্কুল সেদিন মরা। এক বিন্দু হাসি থাকে না মেয়েদের কারো মুখে। : বলো কি! তাহলে শবনম আম্মা বাড়িতে এমন আচরণ করে কেন? আর বাড়িতেই বা বলি কেন, বাড়ির বাইরেও সে ইদানিং কারো সাথে ভাল আচরণ করছে না। সব সময় দম্ভ আর দাপট দেখায় সবাইকে। : আমি বলি কি হুজুর, আম্মাজানকে এ যাবত তো কেবলই আধুনিক শিক্ষা দেয়া হয়েছে, এবার কিছুটা দীনি এলেম দেয়া হোক। এটা তার বিশেষ দরকার আছে। খান বাহাদুর সাহেব নারাজকণ্ঠে বললেন- দরকার আছে মানে? আরো তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার কথা বলছো? : জি হুজুর। ইসলামী শিক্ষা। : আরে রাখো তোমার ইসলামী শিক্ষা! ঢের হয়েছে। আর কোন শিক্ষাই দরকার নেই। : হুজুর! : গত বছরই সে বিএ পাশ করেছে। অনেকখানি বয়স হয়েছে তার। এখন যত শিগ্গির সম্ভব তার বিয়ে-শাদিটা দিয়ে দেবো বলেই তাকে আর পড়ার জন্যে ভার্সিটিতে পাঠাইনি। এবার তোমরা সবাই মিলে ওর শাদির চেষ্টাটা করো একটু। দেখেশুনে একটা সৎ পাত্র আনো। : সেটা তো দেখছিই হুজুর। আপনি বলার পর থেকেই সব সময় দেখছি। কিন্তু আমরা চাইলেই তো হবে না। সব কিছুই আল্লাহ তায়ালার হাতে। আল্লাহর যেদিন ইচ্ছে হবে, সেদিন ঠিকই সৎ পাত্র জুটে যাবে। তার আগে হাত পা ছুড়ে তো লাভ নেই। : ব্যস্। তাহলে মেয়েটা এখন ঐভাবেই পড়ে থাকবে? তার গতি কিছু হবে না? : হবে হুজুর। ঐ যে বললাম, আল্লাহর যেদিন মর্জি হবে, সেদিন ঠিকই হবে। খান বাহাদুর সাহেব অধের্যকণ্ঠে বললেন- তাহলে এখন মেয়েটাকে নিয়ে করি কি? ম্যানেজার কোরবান আলী মিয়া বিনীতকণ্ঠে বললেন- এই ফাঁকে ওকে কিছুটা দীনি এলেম দিন হুজুর। কিছুটা দীনি এলেম পেলেই মেয়েটা আপছে আপ্ শান্তশিষ্ট আর সুবোধ মেয়ে হয়ে যাবে। বিয়ে-শাদি দিলেই তো হবে না। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যদি এই আচরণই করে, আচরণ না বদলায় তাহলে সেটা কি সইবে তারা, না টিকবে তার সেই শাদি! খান বাহাদুর সাহেব একজন মস্ত বড় জমিদার। রাশভারী মানুষ। শাদি দিলেও সে শাদি টিকবে না তার মেয়ের- এ কথায় জমিদার খান বাহাদুর সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি চিন্তিতকণ্ঠে বললেন- সে কি! এ আবার তুমি কি বলছো ম্যানেজার? ম্যানেজার সাহেব শক্তকণ্ঠে বললেন- ঠিকই বলছি হুজুর। যেটা প্রয়োজনীয় কথা, সেইটেই বলছি। : ম্যানেজার! : আল্লাহ রাসূলের সাথে পরকালের জ্ঞান কিছুটা দিন ওকে। পরকালের চিন্তাভাবনা ওর মাথায় কিছুটা ঢুকুক। একবার তা ঢুকলে, আম্মাজান আপছে আপ্ পাল্টে যাবে। সুবোধ সুধীর হয়ে যাবে। তখন সে বুঝতে শিখবে- এ দুনিয়াটা দু’দিনের। এটা কিছুই নয়। পরকালটাই আসল। অনন্তকাল তার ব্যাপ্তি। অনন্তকাল তাকে সেখানেই থাকতে হবে। পুণ্য কিছু অর্জন করতে না পারলে, তাকে অশেষ আজাব ভোগ করতে হবে সেখানে। : কোরবান মিয়া! : মানুষকে ভালবাসতে শেখাই হলো সেই পুণ্য অর্জন করা। ধনী-গরীব, কালো-ধলো নির্বিশেষে সবার সাথে সদাচারণ করে সবাইকে ভালবাসতে পারলে তবেই আল্লাহর তুষ্টি অর্জন করা যায়। আর পরকালের পাথেয় হাসিল হয়। : তার মানে- : শুধু ঐ আধুনিক মানে খেষ্টানী এলেম শিক্ষা করে সে জ্ঞান অর্জন করা যায় না। ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করলে তবেই এ জ্ঞান পাওয়া যায়। আল্লাহ-রাসূলের কিছু ধারণা ওকে দিন হুজুর। সময় থাকতে ওর পরকালটা মজবুত করার চিন্তা করুন। : বেশ, তাহলে তুমি বলো, কিভাবে তা করবো আমি! : কিছু দিনের জন্যে হলেও শবনম আম্মাকে মেয়েদের মাদরাসায় ভর্তি করে দিন। অন্তত কিছুদিন সে ওখানে দীনি এলেম শিখুক। : ঠিক আছে। কিন্তু তেমন মাদরাসা এখন পাচ্ছি কোথায়? : ঐ রসূলপুরের মাদরাসার কথা বলছি হুজুর। সেখানে শুধু মেয়েরাই ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করে। বড় বড় মেয়েরা ওখানে পড়ে আর ওখান থেকে আলেম, ফাজেল, কামেল- এসব ডিগ্রী লাভ করে। : কিন্তু সে কি! রসূলপুর তো অনেক দূর। এখান থেকে প্রায় তিন সাড়ে তিন মাইল পথ। আমার শবনম সাদিকা আম্মা সেখানে পড়তে যাবে কি করে? : হুজুর! : সে এই পাশের মহিলা কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছে। বৃদ্ধ ড্রাইভার মমতাজ শেখ একাই তাকে নিয়ে গেছে একাই তাকে এনেছে। কিন্তু ঐ রসূলপুরের ব্যাপারটা তো তেমনটি হবে না। : কেন হবে না হুজুর? : কি করে হবে? রসূলপুরের মাদরাসাতে দেয়া নেয়া করতে আর একজন এক্সট্রা লোক লাগবে দৈনিক। মমতাজ শেখ তো গাড়িটা ঐ মাদরাসার বাউ-ারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারবে না। গাড়ি তাকে বাইরে রাখতে হবে আর গাড়ির পাহারায় তাকে গাড়িতেই থাকতে হবে। অন্য আর একজনের দৈনিক শবনম আম্মাকে গাড়ি থেকে নিয়ে মাদরাসার ক্লাস রুমে পৌঁছে দিতে হবে আর ক্লাস শেষে ফের তাকে গাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ দৈনিক বাঁধা আর বিশ্বস্ত একজন লোক দরকার। দৈনিক সে লোক পাবো কোথায়? : আছে তো হুজুর। একদম বসে আছে। আপনি হুকুম করলেই পুরোপুরি সে এই কাজে লেগে যাবে। : শুধু লেগে গেলেই তো হবে না। বিশ্বস্ত লোক হওয়া চাই। এমন লোক অবসর আছে কে কোথায়? : আছে হুজুর আছে। যেমনই বিশ্বস্ত তেমনই এই কাজের উপযুক্ত লোক। লোকটা ফালতু বসে আছে। : বলো কি! কে সে? : ঐ মৌলভী নূরু মিয়া হুজুর। এসে অবধি সে প্রায় ফালতুই বসে আছে। : কে, ঐ নূরু মিয়া? : জি। ঐ নূরু মিয়া। ঐ যে কেতাব আলীকে খামার বাড়ির পাইট্-কিষাণদের নামায-কালাম শেখানোর জন্যে একজন মৌলভী আনতে বলেছিলেন, সেই মৌলভী সাহেব। : ও, কেতাব আলীর আনা ঐ মৌলভী? সে তো শুনেছি একেবারেই এক ছেলে মানুষ। নামাযটা নাকি সে শেখাতে পারে, এই মাত্র। ঐ ছেলে মানুষ কোন কাজে আসবে? : আসবে হুজুর, আসবে। ছেলে মানুষ হলে কি হবে, ছেলেটা একদম এক মাটির মানুষ। খুবই ভাল মানুষ বলেই তো কেতাব আলী ওকে পছন্দ করে এনেছে। : তাই বলে ঐ নূরু মৌলভী আমার সোমত্ব মেয়ের সাথে মাদরাসায় যাবে? : দোষ নেই হুজুর। ঐ যে বললাম, নূরু মৌলভী একেবারেই এক মাটির মানুষ। সাত চড়ে একটা রা শব্দ করে না। নজরটা সব সময় মাটির দিকে রাখে। এদিক ওদিক চায় না। কোন মেয়ে ছেলের মুখের দিকে জান গেলেও তাকায় না। হুশ বুদ্ধি কিছুটা কম কি না তাই অন্য কোন চিন্তাই তার মাথা মগজে নেই। : হুঁশ বুদ্ধি কম? : অনেকখানি কম। একেবারেই আলাভোলা মানুষ। ওকে নিয়ে কোন সমস্যাই নেই। আর তাছাড়া, আম্মাজানকে তো বোরকা দিয়ে মুখ ঢেকে মাদরাসায় যেতে হবে। খোলা মাথা এ্যালাও করা হয় না। কাজেই সমস্যা কোথায়? : ঠিক বলছো? : জি জি। কেতাব আলীর কাছে সব কিছু জেনে নিয়ে তবে বলছি। : কেতাব আলীই বা তাকে যোগাড় করলো কোথা থেকে আর কিভাবে? : পথে হুজুর পথে। পথেই আলাপ। আলাপ করে কেতাব আলী বুঝতে পেরেছে লোকটা খুবই লাজুক আর খুবই ভাল মানুষ। হুশে খানিকটা কম বলে কোন সাতে পাঁচে সে থাকে না। ওদিকে আবার ইসলামী জ্ঞানটা তার টনটনে। সব সময় সে দোয়া কালাম আওড়ায় আর মাঝে মাঝে আনমনে ইসলামী গজল গায়। : কিন্তু রাস্তায় একবার দেখেই কেতাব আলী এত সব জানলো আর বুঝলো কি করে? : ও পাড়ার চেরাগ আলী তাকে সব বলে দিয়েছে যে! আগে ঐ চেরাগ আলীর মুনিবের বাড়িতেই সে ছিল। চেরাগ আলীর মুনিব অনেক দিনের জন্যে অন্যত্র চলে গেলেন বলে নূরু মিয়াকে আর রাখতে পারলেন না। একটা ভাল বাড়ি দেখে নূরু মিয়াকে রাখার কথা বলে গেছেন। মানে, চেরাগ আলীকে সে ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বলে গেছেন। : তাই নাকি? : তার পরই তো আমাদের কেতাব আলী তাকে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। : বলো কি!