আরেকবার সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে দাদুদের সামনাসামনি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ১০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পনেরো জন বন্দি হয়। একবার দাদুরা খবর পেলেন, নৌকা বোঝাই হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের গ্রামের দিকে আসছে। রাজাকারদের কাছে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর পেয়েছিল। তাদের কাছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে বোমা মেরে আক্রমণ করে। দুই নৌকা ভরতি পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকারের দল। রাজাকারদের মাথায় সাদা টুপি এবং সৈন্যদের মাথায় হেলমেট। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দুটি নৌকাই নদীর পানিতে ডুবে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা সাঁতার জানে না। রাজাকারদের অনেকে সাঁতার কেটে তীরে উঠলে তাদের বন্দি করা হয়। রাজাকাররা সবাই বাঙালি। তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের পথ দেখিয়ে গ্রামে নিয়ে আসত। শত্রদের সঙ্গে তারা মানুষের ঘরবাড়ি লুটপাট করত, আগুন লাগাত আর গ্রামবাসীদের হত্যা করত। রাজাকাররা না থাকলে অনেক আগেই দেশ স্বাধীন হতো। শাহেদ জিগ্যেস করে, যুদ্ধে শুধু পাকিস্তানি সৈন্যরা মারা যেত, তোমাদের মধ্যে কেউ হতাহত হতো না? দাদু বলেন, আমাদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছে, আহত হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় লড়াইয়ের সময় আমার এক সহযোদ্ধা সুবেদার করিম বক্স আহত হয়। আমি শত্রæর গোলাগুলি উপেক্ষা করে, ক্রলিং করে এবং গুলি ছুড়ে করিম বক্সকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। আমার ডান পায়ে গুলি লাগে। এই দেখো না, এখনও আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলিÑবলে পা দেখালেন দাদু।
"শাহজাহান কিবরিয়ার পোশাকি নাম মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া। জন্ম ২৪ জানুয়ারি ১৯৪১। নোয়াখালী জেলার অধুনালুপ্ত শহর এবং মাইজদী কোর্ট শহরে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। ১৯৫৭ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। বি এ প্রথম বর্ষ ঢাকা কলেজ ও পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৬৩ সালে বি এ (সম্মান)। ১৯৬৪ সালে বাংলায় এম এ পাস করেন। ১৯৬৩ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু। পরে দৈনিক গয়গাম, ফ্র্যাঙ্কলীন বুক প্রেত্মামস, পাকিস্তান কাউন্সিলর, দৈনিক গণবাংলা, দৈনিক পূর্বদেশ, বাংলা একাডেমি এবং সবশেষে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। শাহজাহান কিবরিয়া মৃদুভাষী, সজ্জন, অন্তর্মুখী মানুষ, তবে অন্তরে তাঁর রয়েছে দৃঢ়চিত্ততা এবং এর উৎস যেমন তাঁর ব্যক্তিসত্তা, তেমনই স্বদেশাত্মার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা। নিভৃতচারী সাধকের মানস তিনি ধারণ করেন ভেতরে, বাইরের আড়ম্বর সযত্নে পরিহার করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকটা সময় ছিল তমসাচ্ছন্ন, সেই বৈরি পরিবেশেও তিনি যথাসাধ্য সচেষ্ট ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে স্নাত করা, বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের বাণী পৌঁছে দিতে। এই কাজে তাঁর অবলম্বন হয়েছে শিশু- কিশোরদের জন্য লেখালিখি এবং সৃজনশীল সাহিত্য রচনা। শাহজাহান কিবরিয়া সাহিত্যে মূল্যবান অবদান রাখার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও শিশু একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক পুরস্কার পান। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৫০টির অধিক। সহজ সরল সাহিত্য উপাদান ও শাণিত নির্মাণশৈলী তাঁর রচনার প্রাণ। তিনি একদিকে নিজস্ব মৌলিক রচনার মধ্য দিয়ে পাঠক হৃদয় জয় করেছেন, অন্যদিকে বিদেশি রূপকথা ও লোককাহিনি অনুবাদ করে আমাদের শিশু সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত করেছেন। তাঁর রচনায় রয়েছে আলাদা মাধুর্য ও শক্তি।"