উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুররা আমাদের চিরকালের উপকথাগুলো ভাষার রং মাখিয়ে নিজেদের মতো করে রচনা করে বাংলার শিশুদের মনে স্থান করে নেন। অধুনা বাংলাদেশে অসংখ্য রূপকথার বই বের হচ্ছে নিরন্তর। এক্ষেত্রে শিক্ষিত লেখক-অনুবাদকরা বিশ্বরূপকথার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। বড়োরাও মুগ্ধচিত্তে এই অপরূপ কাহিনিগুলোর আস্বাদ নেন এবং কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্য এক অপরূপ জগতে হারিয়ে যান। এসব লেখক অন্য রূপকথাকেও নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনার রঙে ভাষার মায়াবী জাদুতে তা রচনা করেন একেবারে নিজের মতো করে। জসীম উদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকের হাত থেকে এমন অসংখ্য রূপকথা-উপকথা শিশুরা উপহার পেয়েছে। তবে যে নামটি আমাদের শিশু ও রূপকথাপ্রিয় পাঠকদের কাছে খুবই প্রিয় তিনি শাহজাহান কিবরিয়া। শাহজাহান কিবরিয়া রূপকথা ছাড়াও অসংখ্য মৌলিক শিশু-কিশোর গল্প-উপন্যাসও রচনা করেছেন। বিশেষ করে অতিকিশোর এবং প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য তিনি অদ্বিতীয় লেখক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলিও শিশুদের কাছে খুব প্রিয়। আর তাঁর রূপকথা পড়েই বোঝা যায় এর লেখক কে। এক্ষেত্রে তাঁর একটা পেলব ভাষা আছে এবং স্টাইলটাও তাঁর একেবারে নিজস্ব। এখানেই শাহজাহান কিবরিয়া অন্যদের থেকে আলাদা। অসংখ্য রূপকথা তাঁর হাত দিয়ে নতুন অবয়বে নবসৃষ্টির আদল পেয়েছে। আমাদের শৈশব-কৈশোর তাঁর 'বিড়ালের গলায় ঘণ্টা', 'প্রাচ্যের রূপকথা'- ইত্যাদি পড়ে-পড়ে বেড়ে উঠেছে। বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই কৃতী শিশুসাহিত্যিক। আগেই বলেছি অসংখ্য বই তাঁর-এবং অধিকাংশই রূপকথা উপকথা। স্বরবৃত্ত প্রকাশন আগে তাঁর বেশ কয়েকটা বই বের করেছে, এবার তাঁর 'আফ্রো-এশীয় রূপকথা' অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮-তে এনেছে। আমাদের বিশ্বাস তাঁর এই অসাধারণ মায়া-জাদুমাখা অপরূপ কাহিনির এই বইটি শিশু-কিশোরদের তো বটেই, বড়োদের মনোলোকও পাঠস্নিগ্ধতায় ভরিয়ে রাখবে
"শাহজাহান কিবরিয়ার পোশাকি নাম মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া। জন্ম ২৪ জানুয়ারি ১৯৪১। নোয়াখালী জেলার অধুনালুপ্ত শহর এবং মাইজদী কোর্ট শহরে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। ১৯৫৭ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। বি এ প্রথম বর্ষ ঢাকা কলেজ ও পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৬৩ সালে বি এ (সম্মান)। ১৯৬৪ সালে বাংলায় এম এ পাস করেন। ১৯৬৩ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু। পরে দৈনিক গয়গাম, ফ্র্যাঙ্কলীন বুক প্রেত্মামস, পাকিস্তান কাউন্সিলর, দৈনিক গণবাংলা, দৈনিক পূর্বদেশ, বাংলা একাডেমি এবং সবশেষে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। শাহজাহান কিবরিয়া মৃদুভাষী, সজ্জন, অন্তর্মুখী মানুষ, তবে অন্তরে তাঁর রয়েছে দৃঢ়চিত্ততা এবং এর উৎস যেমন তাঁর ব্যক্তিসত্তা, তেমনই স্বদেশাত্মার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা। নিভৃতচারী সাধকের মানস তিনি ধারণ করেন ভেতরে, বাইরের আড়ম্বর সযত্নে পরিহার করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকটা সময় ছিল তমসাচ্ছন্ন, সেই বৈরি পরিবেশেও তিনি যথাসাধ্য সচেষ্ট ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে স্নাত করা, বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের বাণী পৌঁছে দিতে। এই কাজে তাঁর অবলম্বন হয়েছে শিশু- কিশোরদের জন্য লেখালিখি এবং সৃজনশীল সাহিত্য রচনা। শাহজাহান কিবরিয়া সাহিত্যে মূল্যবান অবদান রাখার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও শিশু একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক পুরস্কার পান। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৫০টির অধিক। সহজ সরল সাহিত্য উপাদান ও শাণিত নির্মাণশৈলী তাঁর রচনার প্রাণ। তিনি একদিকে নিজস্ব মৌলিক রচনার মধ্য দিয়ে পাঠক হৃদয় জয় করেছেন, অন্যদিকে বিদেশি রূপকথা ও লোককাহিনি অনুবাদ করে আমাদের শিশু সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত করেছেন। তাঁর রচনায় রয়েছে আলাদা মাধুর্য ও শক্তি।"