১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এবং '৭১-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাতচল্লিশে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হলেও পাকিস্তানের একটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান তখনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের মতোই পূর্ববাংলার জনগণকে শোষণ করে আসছিল। পূর্ববাংলার নাট্যকাররা স্বতন্ত্র বাংলা ভাষা পেলেও দু'দুবার পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকারের শাসনশোষণে জনগণ এতটাই নির্যাতিত ছিল যে, নাট্যকারদের পক্ষে নাটকে সমকালের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা সম্ভব ছিল না। ফলে তারা বিষয় হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন ইতিহাসঐতিহ্যকে। আবার সমকালের রাজনৈতিক বিষয়কে তুলে ধরতে বেছে নিয়েছেন কখনো প্রতীক, কখনোবা রূপকের আশ্রয়। কিন্তু ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সাধারণ জনগণের মধ্যে যেমন সঞ্চার হয়। নতুন চেতনা, তেমনি নাট্যকাররা তাদের নিজস্ব মতামতকে প্রকাশ করার জন্যে পেয়ে যান শৈল্পিক-স্বাধীনতা। স্বাভাবিকভাবেই পুরোনো ধারার নাট্য-ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে সমকাল ও স্বদেশ সচেতন নাট্যকাররা ব্যাপৃত হন অভিনব বিষয়-বৈচিত্র্য ও শৈলী-চেতনা সমৃদ্ধ নাট্যরচনায় ।। দুই কাল-পর্বের দুটো বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাট্যকাররা কীভাবে তাদের নাটকে সমকালীন যুগযন্ত্রণাজাত বৈচিত্র্যময় বিষয়কে চিত্রিত করেছেন, সমকালের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা আলোচনার পাশাপাশি এ বিষয়টিই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে বর্তমান গ্রন্থে। যেকোনো কালের বৈচিত্র্যময় বিষয়-ভাবনাকে নাটকের মাধ্যমে যেভাবে পাঠক এবং দর্শকদের সামনে তুলে ধরা যায়, সাহিত্যের অন্য কোনো মাধ্যমে সেভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। শিল্পের কাছে জীবনের প্রত্যাশিত জলসিঞ্চন করতে সমর্থ। বলেই সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মাধ্যমটি—এই ভূখণ্ডে বরাবরই এত গভীর, এত অন্তর্ভেদী ও বাস্তবানুগ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে। আশা করি বাংলাদেশের নাটক : বিষয়-চেতনা (১৯৪৭-১৯৮২) এই গ্রন্থটি ভবিষ্যৎ নাট্যগবেষকবৃন্দের গবেষণায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে।