এই গ্রন্থে সেই স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী এবং কেন এবং কিভাবে সে-স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তা আলোচনা করেছি। আলোচনা করা হয়েছে, দারিদ্রমুক্তির নামে আমরা কিভাবে দারিদ্রকে লালন করেছি; কিভাবে দারিদ্রকে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রামের-সম্পদ-হরণে; কিভাবে গত চার দশকে এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটা লুটেরা পুঁজিপতি (প্রকৃত ঝুঁকি গ্রহণকারী পুঁজিপতি নয়) শ্রেণী তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল একটা বিরাট স্বপ্ন নিয়ে। সে-স্বপ্ন হল বাংলাদেশ হবে একটা দারিদ্রমুক্ত, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, গণতান্ত্রিক, আধুনিক রাষ্ট্র। সে লক্ষ্যে ১৯৭২-এ একটা অসাধারণ সংবিধানও রচনা করা হয়। সেই সংবিধানে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে, প্রতিটি মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বের মর্যাদা দেওয়ার প্রয়াস নেয়া হয়, তাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সব মানবিক মৌলিক অধিকারের, যাতে সে তার জীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। কিন্তু মনে হয় সে স্বপ্নকে ফলপ্রসূ করার প্রয়াস থেকে আজ আমরা বহুদূরে সরে গেছি। এই গ্রন্থে সেই স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী এবং কেন এবং কিভাবে সে-স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তা আলোচনা করেছি। আলোচনা করা হয়েছে, দারিদ্রমুক্তির নামে আমরা কিভাবে দারিদ্রকে লালন করেছি; কিভাবে দারিদ্রকে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রামের-সম্পদ-হরণে; কিভাবে গত চার দশকে এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটা লুটেরা পুঁজিপতি (প্রকৃত ঝুঁকি গ্রহণকারী পুঁজিপতি নয়) শ্রেণী তৈরি করা হয়েছে। এই শ্ৰেণীটি যে-সমাজ গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে তৈরি করেছে তা একটি বৈষম্য-দুষ্ট অতিঅমানবিক সমাজ। আলোচনা করা হয়েছে, এই দুষ্ট মানববিদ্বেষী দারিদ্রক্লিষ্ট সমাজকে ভাঙতে হলে রাষ্ট্রকেই মুখ্য উদ্যোগ নিতে হবে, এবং সেই উদ্যোগে দেশের সব মানুষকেই যুক্ত করতে হবে। গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচনে বর্তমানে যে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেই ব্যর্থতার কারণ কি এবং তাথেকে মুক্তির উপায় কি, তাও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
অনুপম সেন একজন জ্ঞানতাপস, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিরল ব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, অনুবাদক, শিক্ষাবিদ ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবী। অনুপম সেনের জন্ম ১৯৪০ সালের ৫ই আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে। তাঁর মাতা স্নেহলতা সেন ও পিতা বীরেন্দ্রলাল সেন। বীরেন্দ্রলাল সেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ এবং রিপন কলেজ থেকে বিএল ডিগ্রি অর্জন করে ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তাঁর প্রমাতামহ ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত ও তিব্বত-পরিব্রাজক শরচ্চন্দ্র দাশ। শরচ্চন্দ্র কর্তৃক তিব্বত থেকে উদ্ধারকৃত ও অনূদিত মহাকবি ক্ষেমেন্দ্রের 'বোধিসত্ত্ব অবদান কল্পলতা'-এর গল্প অবলম্বন করেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন 'শ্যামা', 'পূজারিনী' প্রভৃতি অসাধারণ নৃত্যনাট্য ও কবিতা। তাঁর জ্যেষ্ঠতাত ছিলেন বাংলা সমালোচুল সাহিত্যের জনক কবিভাস্কর শশাঙ্কমোহন সেন। স্বাভাবিক যে, অনুপম সেন শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠার সুযোগ পান। অনুপম সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব বিষয়ে বিএ (অনার্স) এমএ এবং কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ চার দশক ধরে শিক্ষকতা পেশায় ব্রতী ছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সমাজতত্ত্বের ছাত্র হলেও তাঁর পড়াশোনা ও গবেষণার ক্ষেত্র বহুমাত্রিক। মানবসভ্যতার ইতিহাস, বাঙালি রেনেসাঁস, বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দেশচেতনা ইত্যাদি তাঁর জীবনকেন্দ্রিক অধ্যয়নের মূলগত বিষয়। তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কর্মসাধনা তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। শিক্ষা ও সমাজভাবনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৪ সালে 'একুশে পদক'সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রাখেন। বলা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সকল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথের সাহসী মানুষ তিনি। বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশক Routledge তাঁর The State, Industrialization and Class Formations in India গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। এছাড়াও তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ- 'বাংলাদেশ: ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও মুক্তির স্বপ্ন'; 'কবি-সমালোচক শশাঙ্কমোহন সেন'; 'সাতটি বক্তৃতা: বাঙালি-মনন, বাঙালি সংস্কৃতি'; 'সুন্দরের বিচার সভাতে'; 'বিলসিত শব্দগুচ্ছ'; 'জীবনের পথে-প্রান্তরে'; 'বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ, সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ'; 'বাংলাদেশ ও বাঙালি রেনেসাঁস, স্বাধীনতা-চিন্তা ও আত্মানুসন্ধান'; 'ব্যক্তি ও রাষ্ট্র: সমাজ-বিন্যাস ও সমাজ-দর্শনের আলোকে; 'আদি-অন্ত বাঙালি বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ'; ইতিহাসে অবিনশ্বর: 'অসাম্যের বিশ্বে সাম্যের স্বপ্ন' পাঠকসমাজে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়েছে