ফ্ল্যাপে লিখা কথা আধুনিক বাঙালির প্রিয়তম কবি জীবনানন্দ দাশ। যে-জীবনানন্দ তাঁর জীবৎকালে ছিলেন উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত, কখনো কখনো নিন্দিত ও কুখ্যাত, অল্প কয়েকজন সুধী ব্যক্তি যাঁর প্রতিভা চিনতে পেরেছিলেন, মৃত্যুর পরে সেই জীবনানন্দ বাঙালির হৃদয় উত্তরোত্তর দখল করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে জীবনানন্দ দাশই সারা পৃথিবীর যে-কোনো স্থানের বাঙালিকে অধিকার করে আছে। এই বিজয় এক অসাধ্য সাধন, কেননা তা শুধুমাত্র কবিতার দ্বারা সাধিত হয়েছে, পূর্বোক্ত দুই মহাজনের মতো তাঁর নেই কোনো সুর-সঞ্চালিত গানের অক্ষয় ভাণ্ডার। তারপটরেও জীবনানন্দ একালের বাংলা কবিতার উচ্চতম বিজয়স্তম্ভটি রচনা করেন। তার কারণ আধুনিক বাঙালির দ্বন্দ্ব বেদনা ও আনন্দকে জীবনানন্দ যে-ভাবে বাণীরূপ দিয়েছেন, আর কেউ তা পারেন নি।
জীবনানন্দ দাশ ।তিহ্যকে গ্রহণ করেছেন- কিন্তু তা আমাদের সমকাল ও ভবিষ্যৎকে অগ্রসর করে দেবার জন্যে। তাঁর ইতিহাসচেতনা যেমন দেশজ, তেম্নি আন্তর্জাতিক। পায়ের নিচের ঘাসকে যেমন তিনি রূপ দিয়েছেন, তেম্নি রূপ দিয়েছেন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রকে। আমূল রোমান্টিক কবি তিনি। বাংলা কবিতায় নারী ও নিসর্গের শ্রেষ্ঠ রূপকার তিনি। আবার তাঁর কালের দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা-দেশবিভাগকে তিনি তুলে এনেছেন কবিতায়। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর-পরই নীহাররঞ্জন রায় যে তাঁকে ‘মহত্তম কবি’ অভিধা দিয়েছিরৈন- আজ দেখা যাচ্ছে- তা দিবালোকের মতো সত্য ও দীপ্যমান। শুধু বাংলা ভাষার নয়, পৃথিবীর যে-কোনো ভাষা-সাহিত্যের নিরিখে জীবনানন্দ দাশ মহত্তম কবি।
কবির জীবদ্দশায় তাঁর মাত্র সাতটি কবিতাগ্রন্থ বেরিয়েছিলো। এই কবিতাগ্রন্থগুলিতে মাত্র তাঁর ১৬২টি কবিতা গৃহীত হয়েছিলো। ইতিমধ্যেই জীবনানন্দ রচিত ঐ সংখ্যা চার গুণ কবিতা আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান সংগ্রহে সেই বিরাট কবিতা-ভাণ্ডার থেকে সযত্নে শ্রেষ্ঠ ও লোকপ্রিয় কবিতাগুলি সংকলন করা হয়েছে।
কিন্তু ইতিমধ্যেই যা সমস্ত বাঙালি পাঠককে বিস্মিত ও চমৎকৃত করেছে, তা হচ্ছে জীবনানন্দ রচিত কয়েকটি উপন্যাস এবং অজস্র ছোটোগল্পের প্রকাশ। এই উপন্যাস ও গল্পগুচ্ছে যে জীবনানন্দকে আমরা পাই, তিনি কেবল কবি জীবনানন্দের সম্প্রসার নন-সম্পূরক সত্তাও। বর্তমান সংগ্রহে জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ তিনটি উপন্যাস-মাল্যবান, বিভা ও নিরুপম যাত্রা গৃহীত হয়েছে। আর সংকলিত হয়েছে অনেকগুলি ছোটোগল্প।
এখন দেখা যাচ্ছে, জীবনানন্দ বেশ-কিছু প্রবন্ধ ও সমালোচনাত্মক রচনা প্রণয়ন করেছেন। বর্তমান সংগ্রহে জীবনানন্দের কয়েকটি জাজ্বল্যমান প্রবন্ধ ও বইরিভিয়্যু গ্রথিত হয়েছে। এছাড়াও আছে জীবনানন্দের পত্রাবলি থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চিঠি। তাঁর সর্বশেষ-আবিষ্কৃত কবিতা ও গল্পও যোজিত হয়েছে।
বর্তমান সংগ্রহের সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ গত পঁচিশ বছর ধরে অনবচ্ছিন্নভাবে জীবনানন্দ চর্চা করে চলেছেন। তাঁরই কল্যাণে আবিষ্কৃত হয়েছে জীবনানন্দের অনেক অগ্রন্থিত কবিতা, কবির লেখা প্রথম প্রবন্ধ ও বইরিভিয্যুগুলি। বর্তমান সংগ্রহে প্রথমবারের মতো গ্রন্থর্ভূত হলো জীবনানন্দের একটি অজ্ঞাত রচনা ‘কালপুরুষের উক্তি’। রচনার পরে সে অস্বাক্ষরিত রচনাটি মান্নান সৈয়দই নিয়ে এলেন দিনের আলোয়।
এই সংগ্রহের পরিশেষ-অংশে জীবনানন্দ সম্পর্কিত বিপুল তথ্য সমাহৃত হলো। কবিপত্নী লাবণ্য দাশ, কবিভ্রাতা অশোকানন্দ দাশ, ভ্রাতৃবধূ নলিনী দাশ ও কবিকন্যা সঞ্জুশ্রী দাশের সাক্ষাৎকার; কবির পিতা সত্যানন্দ দাশ প্রতিষ্ঠিত সম্পাদিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকা সম্পর্কে তথ্যাবলি; কবির পরিবার-পরিজনদের লেখার নমুনা; ইত্যাদি বহু বিষয় গ্রন্থশেষে নিবিষ্ট করা হয়েছে।
শ্রেষ্ট জীবনানন্দ কবি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে অপরিহার্য এক গ্রন্থ।
Title
শ্রেষ্ঠ জীবনানন্দ : জীবনানন্দ রচনাবলীর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সংকলন
আবদুল মান্নান সৈয়দ (৩ আগস্ট ১৯৪৩ - ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাহিত্য-সম্পাদক। তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের "পোয়েট ইন রেসিডেন্স" ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ষাট দশক থেকে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে তার গবেষণাধর্মী অবদান ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের উপর তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্ম রয়েছে। তিনি ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বেগম রোকেয়া, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদককে নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যমহলে তিনি 'মান্নান সৈয়দ' নামেই পরিচিত ছিলেন।