উনিশ শ একাত্তর সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার হাজার বছরের ইতিহাসে এক গৌরবগাথা। সেইসঙ্গে অপমান, যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনারও রক্তাক্ত ইতিহাস। নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতির ওপরে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর অকথ্য পাশবতা ও হত্যাযজ্ঞ এবং তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে সার্বিক ধ্বংসলীলা হিটলারের নাৎসিবাহিনীর ভয়াবহ অত্যাচারকেও হার মানায়। ভেতো ও ভীতু বাঙালির কিংবদন্তিকে নস্যাৎ করে সেদিন বাঙালি জাতি সংঘবদ্ধ ও সংহত হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল মাতৃভূমিকে বাঁচাবার জন্যে, পশুত্বের ওপরে মনুষ্যত্ব ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে, নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে নিজেকে ও নিজের জাতিকে রক্ষা করার সুদৃঢ় সংকল্প নিয়ে। এর বিনিময়ে মূল্য দিতে হয়েছে অকল্পনীয় : ২৫শে মার্চ ১৯৭১-এর কালরাত্রি থেকে ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ত্রিশ লক্ষ দেশপ্রেমী জনগণের মৃত্যুবরণ, লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমী জনগণের মৃত্যুবরণ, তিন লক্ষ জায়া-কন্যা-জননী-ভগিনীর শারীরিক লাঞ্ছনা, ছিন্নমূল হয়ে-যাওয়া এক কোটি মানুষের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উদ্বাস্তু-আশ্রয়শিবিরে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টে দীর্ঘ ন’ মাস কালাতিপাত এবং দেশের অভ্যন্তরে রয়ে-যাওয়া অসহায় মানুষের বন্দিশিবিরে বসবাসের ত্রাস, উৎকণ্ঠা, অপমান ও গ্লানি। কতিপয় দেশ ও জাতি-দ্রোহী আল্-বদর, রাজাকার, আল্-শাম্স্ ব্যতিরেকে সেদিন স্বদেশরক্ষার মহাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি কে? নির্বিচারে সকল বয়সের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল ধর্মসম্প্রদায়ের লোক এবং ধনী-গরিব ভেদাভেদহীন সকল বৃত্তির মানুষ, এমনকি টোকাই, সমাজবিরোধী অপরাধী, নিষিদ্ধ পল্লীর জনমদুখিনীটি পর্যন্ত। এভাবেই সকল বাঙালির অশ্রু ও শ্রম এবং হতাশাজয়ী স্বপ্ন দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়েছিল। প্রতিরোধে ও প্রতিশোধে যে অদম্য ও অপরাজেয় নবীন বাঙালির জন্ম হয়েছিল তার মুখও এর পূর্বে অচেনা ছিল ইতিহাসে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের যেমন উৎসভূমি, তেমনি এক নতুন বাঙালি-জাতিসত্তাচেতনারও স্রষ্টা। আমাদের চোখ থেকে পুরোনো পৃথিবী মুছে দিয়ে নতুন পৃথিবীর সামনে সে দাঁড় করায় আমাদের। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শিল্পে ও সাহিত্যে তার উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের চিত্রী, ভাস্কর, গাল্পিক, কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রনির্মাতা সকলেই মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে তাঁদের সৃজনপ্রতিভার উৎসারণ ঘটিয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ সেই ঐতিহাসিক সময়েরই কাহিনী। আমাদের অর্জন ও বঞ্চনা, স্বপ্ন ও আশাভঙ্গ, হাস্যমাধুরী ও অশ্রুধারার সন্নিপাতে তৈরি হয়ে-ওঠা সে-দুঃসময়ের চলচ্ছবি এই গ্রন্থের গল্পমালা। প্রবীণতম সত্যেন সেন থেকে সাম্প্রতিক প্রজন্মেও তরুণতম গল্পকার পর্যন্ত সকলেই এখানে উপস্থিত। সে-অর্থে এ বই একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল ও পূর্ণাঙ্গও বটে। দেশের খ্যাতিমান চিত্রকরদেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রকর্মগুলো বর্তমান গল্পগ্রন্থে নতুন মাত্রা সঞ্চার করেছে নিঃসন্দেহে। সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাত দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সাপ্তাহিক সাহিত্য-সাময়িকীরই যোগ্য পরিচালক শুধু নন, তিনি যে এদেশে রুচিমান, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানপ্রবণ ও রসজ্ঞানী সম্পাদকদের অগ্রগণ্য তারও পরিচয় ক্ষোদিত রইল এই গল্পসংকলনে।
আবুল হাসনাত কবি ও সাংবাদিক। তিনি মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা লেখেন। তাঁর জন্ম ১৭ জুলাই ১৯৪৫ সালে পুরনো ঢাকায়। ষাটের দশক থেকে কাব্যচর্চার সূত্রপাত। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ষাটের দশকের প্রতিবাদ ও সংগ্রামমুখর জীবনের প্রতিচ্ছবি যেমন তাঁর কাব্যবিশ্বাসে জায়গা নিয়েছে তেমনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিজনিত আনন্দ-বেদনা, অস্থিরতা, নৈরাশ্য ও সংকটময় মুহূর্তগুলিও তাঁর বোধে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। সবকিছুর অন্তরালে ক্রোমন্টিক কাব্যধারারও প্রবল স্রোত তাঁর চেতনায় নীরবে বয়ে গেছে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: 'জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক', 'কোনো একদিন ভুবনডাঙায়', 'ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল' ও 'নির্বাচিত কবিতা'। প্রবন্ধগ্রন্থ: 'সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য' ও 'জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য'; শিশু ও কিশোরদের নিয়ে রচিত গ্রন্থ: 'ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়', 'টুকু ও সমুদ্রের গল্প', 'যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুর', 'রানুর দুঃখ-ভালোবাসা'; কিশোর জীবনী : 'জসীমউদ্দীন', 'চার্লি চ্যাপলিন', 'সূর্যসেন', 'কিশোরসমগ্র' এবং 'প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য'। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক 'সংবাদে'র সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন। একসময় বাংলাদেশের সাহিত্যের দর্পণ হয়ে উঠেছিল সংবাদ সাময়িকী। বর্তমানে সাহিত্যপত্রিকা 'কালি ও কলমে'র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে চিত্রকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক 'শিল্প ও শিল্পী'র তিনি সম্পাদক। ১৯৮২ সালে টুকু ও সমুদ্রের গল্পে'র জন্য পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৪ সালে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো।