উনিশ শ একাত্তর সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার হাজার বছরের ইতিহাসে এক গৌরবগাথা। সেইসঙ্গে অপমান, যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনারও রক্তাক্ত ইতিহাস। নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতির ওপরে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর অকথ্য পাশবতা ও হত্যাযজ্ঞ এবং তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে সার্বিক ধ্বংসলীলা হিটলারের নাৎসিবাহিনীর ভয়াবহ অত্যাচারকেও হার মানায়। ভেতো ও ভীতু বাঙালির কিংবদন্তিকে নস্যাৎ করে সেদিন বাঙালি জাতি সংঘবদ্ধ ও সংহত হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল মাতৃভূমিকে বাঁচাবার জন্যে, পশুত্বের ওপরে মনুষ্যত্ব ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে, নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে নিজেকে ও নিজের জাতিকে রক্ষা করার সুদৃঢ় সংকল্প নিয়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের যেমন উৎসভূমি, তেমনি এক নতুন বাঙালি-জাতিসত্তাচেতনারও স্রষ্টা। আমাদের চোখ থেকে পুরোনো পৃথিবী মুছে দিয়ে নতুন পৃথিবীর সামনে সে দাঁড় করায় আমাদের। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শিল্পে ও সাহিত্যে তার উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের চিত্রী, ভাস্কও, গাল্পিক, কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রনির্মাতা সকলেই মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে তাঁদের সৃজনপ্রতিভার উৎসারণ ঘটিয়েছেন। সেই সৃষ্টিশীলতার ইতিহাসও তো জাতির ইতিহাস। চৈনিক কথাসাহিত্যিক লু শুন্ বলেছিলেন, কবিতা লিখে বিপ্লব করা যায় না, বিপ্লব হয় বন্দুক দিয়ে। কথাটা সত্যি, আবার সত্যি নয়ও। বিপ্লব, বিদ্রোহ কি মুক্তিযুদ্ধ কোনোটাই অহিংস পদ্ধতিতে হয় না, তাকে সশস্ত্র হতে হয়, কামান বন্দুক গুলি রাইফেল মেশিনগান এইসব মারণাস্ত্র লাগে। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা-যুদ্ধ, রুশ বিপ্লব সকল ক্ষেত্রেই এ-কথা সত্য। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধও তাই। কিন্তু যুদ্ধাস্ত্রই সব নয়, যুদ্ধাস্ত্রই একমাত্র নয়। হলে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা হারত না, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও হারত না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। আসলে, অস্ত্র তো লড়াই করে না, করে মানুষ। তাদেরকে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যোগায় কবিতা, গান, শিল্প। ঐ মানুষগুলোর ভিতরে অন্য মানুষ তৈরি করে দেয় সাহিত্য। তাই যুদ্ধজয়ের জন্য বন্দুকও চাই, কবিতাও চাই। উনিশ শ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, জীবনানন্দ ও সুকান্ত কী অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিলেন মুক্তিফৌজের অন্তরে, সে-ইতিহাস তো আমাদের জানা। যে-দেশ যুদ্ধ করে সে-দেশে ‘যুদ্ধেও সাহিত্য’ ও তৈরি হয়ে ওঠে। যুদ্ধ চলাকালে তো বটেই, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নানান দেশে, স্পেনের প্রতিরোধ-সংগ্রামে এর প্রমাণ ছড়ানো। বাংলাদেশও কোনো ব্যতিক্রম নয়। ‘মুক্তিযুদ্ধেও কবিতা’ সেই প্রণোদনশক্তির সংকলন, সেই বিজয়গাথা। বর্তমান কাব্যসংকলনে প্রবীণতম থেকে তরুণ কবিদের কবিকর্ম এক আধারে সঞ্চয়ন করেছেন আবুল হাসনাত। তাঁরই সম্পাদনায় ইতঃপূর্বে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ গ্রন্থেও সহোদর ও সহগামী সংকলন এ-বই। এ দেশে যাঁদেও শিল্পরুচি, শ্রম, তথ্যনিষ্ঠা ও অনুসন্ধানবৃত্তি রসভোক্তাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে আবুল হাসনাত তাঁদের অন্যতম। বর্তমান কাব্যসংকলন তাঁর সম্পাদনা-কুশলতার আর-এক প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, সন্দেহ নেই।
আবুল হাসনাত কবি ও সাংবাদিক। তিনি মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা লেখেন। তাঁর জন্ম ১৭ জুলাই ১৯৪৫ সালে পুরনো ঢাকায়। ষাটের দশক থেকে কাব্যচর্চার সূত্রপাত। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ষাটের দশকের প্রতিবাদ ও সংগ্রামমুখর জীবনের প্রতিচ্ছবি যেমন তাঁর কাব্যবিশ্বাসে জায়গা নিয়েছে তেমনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিজনিত আনন্দ-বেদনা, অস্থিরতা, নৈরাশ্য ও সংকটময় মুহূর্তগুলিও তাঁর বোধে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। সবকিছুর অন্তরালে ক্রোমন্টিক কাব্যধারারও প্রবল স্রোত তাঁর চেতনায় নীরবে বয়ে গেছে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: 'জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক', 'কোনো একদিন ভুবনডাঙায়', 'ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল' ও 'নির্বাচিত কবিতা'। প্রবন্ধগ্রন্থ: 'সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য' ও 'জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য'; শিশু ও কিশোরদের নিয়ে রচিত গ্রন্থ: 'ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়', 'টুকু ও সমুদ্রের গল্প', 'যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুর', 'রানুর দুঃখ-ভালোবাসা'; কিশোর জীবনী : 'জসীমউদ্দীন', 'চার্লি চ্যাপলিন', 'সূর্যসেন', 'কিশোরসমগ্র' এবং 'প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য'। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক 'সংবাদে'র সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন। একসময় বাংলাদেশের সাহিত্যের দর্পণ হয়ে উঠেছিল সংবাদ সাময়িকী। বর্তমানে সাহিত্যপত্রিকা 'কালি ও কলমে'র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে চিত্রকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক 'শিল্প ও শিল্পী'র তিনি সম্পাদক। ১৯৮২ সালে টুকু ও সমুদ্রের গল্পে'র জন্য পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৪ সালে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো।