ফ্ল্যাপে লিখা কথা পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩) আমাদের কাছে শুধু একটি সম্মোহক নাম নয়- এবং তিনি শুধু সাহিত্যে নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত কবি হিসেবেই পরিচিত নন। বিশ্ব শান্তির শ্বেতকপোত হিসেবে এবং মানবতাবাদী ও যুদ্ধবিরোধী চেতানার দূত হিসেবে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে নন্দিত ও শ্রদ্ধান্বিত ব্যাক্তিত্ব। এই মহান মানবতাবাদী কবি সারাজীবন নিবেদিত ছিলেন সমাজতন্ত্র, মেহনতি মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। প্রেমিক ও বিপ্লবী এই কবি একজন সফল কুটনীতিবিদও ছিলেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ বার্মাতে ছিলেন কয়েক বছর এবং ভারতের দিল্লি, কোলকোতায়ও এসেছেন কয়েকবার। পাবলো নেরুদা ছিলেন জীবনবাদী ও জীবন পিপাসু। ত্যাগেও ভোগে এবং বিপ্লবে প্রেমে তার জীবন এক সম সমীকরণের মোহনীয় মোহনায় মিলিত হয়েছিলো। নেরুদা কমিউনিষ্ট পার্টি করেছেন, সমাজতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যেমন আপোসহীন লড়াতু সৈনিক তেমনি তিনি দেহভোগী। তিনি প্রেমিক, যৌনতা ও নারী আসঙ্গ সুখে সুখী তৃপ্ত এক প্রাণবন্ত ও রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ। দুরন্ত দেহলি বার্মিজ মেয়ে যোসি রিসের সাথে গড়ে ওঠে তার রোমান্টিক প্রেম- তাকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা আবার কলম্বোর বিস্ফোরক দেহলি মেথর যুবতীও হয়েছে তার যৌন-সঙ্গিনী। বহুপ্রেমিকা এসেছে তার জীবনে। যৌনসুখে ছিলেন পরিতৃপ্ত, বিয়েও করেছেন একাধিক। বড়ো আকর্ষণীয় তার জীবন। এই আকর্ষনীয় জীবন পীপাসু কবিরে প্রেম ও বিদ্রোহের কিছু কবিতার সাথে আমাদের ভাষান্তরের মাধ্যমে পরিচিত করেছেন শিকড় সন্ধানী মৌলিক গবেষক ড. সফিউদ্দিন আহমদ। ড. সফিউদ্দিন আহমদ তুলনামূলক সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যে একজন বিদগ্ধ পন্ডিত। অনুবাদ সাহিত্যেও তিনি আমাদের কাছে একজন নন্দিত সাহিত্যিক।তার অনূদিত প্লেটোর The Last days of Socrates এবং টি.এস.এলিয়ট ও ডিরোজিও কবিতার অনুবাদ পন্ডিতজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। এই গ্রন্থে পাবলো নেরুদা জীবন ও কবিতার ওপর রয়েছে ঋদ্ধ, আকর্ষনীয় ও তথ্য সমৃদ্ধ একটি আলোচনা এবং প্রেম ও বিপ্লবের ভাষান্তরিত কিছু কবিতা। আমি আশা করি ড. সফিউদ্দিন আহমদ- এর এই আকর্ষণীয় আলোচনা ও কবিতার ভাষান্তর পাঠককেও আকর্ষণ করবে এবং ভরে দেবে মুদ্ধতায়।
মনিরুল হক
সূচিপত্র প্রেম ও বিপ্লবের কবি পাবলো নেরুদা অনুবাদ প্রসঙ্গে প্রথম পর্ব বিপ্লবের কবিতা: দ্বিতীয় পর্ব প্রেমের কবিতা:
পাবলাে নেরুদা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী লেখক পাবলাে নেরুদা ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই লাতিন আমেরিকার সুদূর চিলিতে এক রেল-শ্রমিক ও স্কুল-শিক্ষিকার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসােয়ালতাে। কৈশােরে তিনি পাবলাে নেরুদা’ ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। কারণ ছিল দুটি- এটা সে যুগের জনপ্রিয় রীতি; আর দ্বিতীয়ত, এই নামের আড়ালে কবিতাগুলি নিজের পিতার কাছ থেকে তিনি লুকিয়ে রাখতেন। কবিতা লিখে অল্প বয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু পরে এক বিচিত্র-জটিল ও বর্ণাঢ্য জীবনযাপনে প্রবৃত্ত হয়ে পড়েন। রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে একসময় হয়ে যান বড় রাজনীতিবিদও।। অন্যায় ও হিংসার বিরুদ্ধে, মানুষের সামাজিক ও আত্মিক বন্দিদশার প্রতিবাদে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে প্রজাতন্ত্রী দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। স্প্যানিস শরণার্থীদের জন্যে লাতিন আমেরিকায় সাহায্য-তহবিল সংগঠিত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলিতে মেক্সিকোর রাস্তায় দেয়ালে-দেয়ালে স্তালিনগ্রাদ-বিষয়ে নিজ কবিতার অনুলিপি সেঁটে বেড়িয়েছেন। সালভাদোর আলিন্দের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন সুনিশ্চিত করার জন্যে তিনি নিজের নামও প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কবিতায় ইউরােপীয় স্যুররিয়েলিজম, সিম্বলিজম ও বাস্তববাদের বিচিত্র প্রভাবের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি। লিখেছেন পরাবাস্তববাদী কবিতা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য, প্রকাশ্য রাজনৈতিক ইস্তাহার। এমনকি কামােদ্দীপনামূলক কবিতার সংকলন টোয়েন্টি পােয়েমস অফ লাভ অ্যান্ড আ সং অফ ডেসপায়ার-এর মতাে গ্রন্থও লিখেছেন। ১৯৭১ সালে তাঁকে সাহিত্যে নােবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একদা নেরুদাকে ‘বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি’ বলে বর্ণনা করেছেন। চে গুয়েভারা ১৭ বছর বয়সে নাকি তাঁর প্রথম প্রেমিকাকে নেরুদার কবিতা শুনিয়েছিলেন। তারপর সারা জীবন ধরে তাঁর লেখা সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।