বাংলা নাটকের প্রথমযুগ মধুসূদন-দীনবন্ধুর যুগ। পরবর্তী যুগাকাশে সূর্য-চন্দ্র গিরিশ-অমৃতলাল। বাংলা আধুনিক নাটকের তৃতীয় পর্ব শুরু হচ্ছে ডিএল রায় ও ক্ষীরোদ প্রসাদকে নিয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার নাট্যচর্চা ও নাট্যাভিনয় উত্তরোত্তর দেশীয় ঐতিহ্য কাটিয়ে পাশ্চাত্য রীতিপদ্ধতির অনুসারী হয়েছিল। দর্শকের নতুন চাহিদা অবশ্য বুঝে নিতে দেরি হয়নি মঞ্চাধিকারীদের। নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনের ভয় থাকাতে ইতিহাস পুরাণ সম্পূর্ণ বর্জন করতে না পারলেও সামাজিক নাটকের প্রযোজনায় তৎপর হয়েছেন নবীন নাট্যকারেরা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতায় আধুনিক বাংলা নাটক তার বিপুল বৈচিত্র্য নিয়ে বাঙালি মননকে তৃপ্ত করে তুলল। গণনাট্য আন্দোলনের সূচনার জন্যে সামাজিক-আর্থিক-রাজনৈতিক পটভ‚মি তৈরি হচ্ছিল চল্লিশের দশকের আগে থেকেই। ১৯৩৬- স্থাপিত প্রগতি লেখক সঙ্ঘের ইস্তাহারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ‘আমাদের বিপর্যস্ত সমাজের দাবি মেনে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা চাই জনসাধারণের সঙ্গে সর্ববিধ কলার নিবিড় সংযোগ।’ এই যুগ সংকটের পটভ‚মিতে নতুন ধরনের নাটক, নাট্যাভিনয় এবং দর্শকরুচি তৈরি করতে এক নতুন নাট্যান্দোলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য হবে, নাটককে মুষ্টিমেয় বিত্তবান ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের ক্ষুদ্র গন্ডী থেকে মুক্ত করে সর্বসাধারণের আনন্দলাভের সামগ্রী করে তোলাই শুধু নয়, তাদের সমাজ-সচেতন ও রাজনীতি সচেতন করে তোলা। ‘নবপর্বে বাংলা নাটক : স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য’ গবেষণাগ্রন্থটি বাংলা রঙ্গমঞ্চে নবনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ পুরুষের এই দায়বদ্ধতার নব-নব পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক নাট্যসৃষ্টি নিয়েই রচিত। নবনাট্য আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় ছিল চাঞ্চল্যের, উত্তেজনার, উদ্দীপনার। এই প্রেক্ষিতকে সামনে রেখেই আধুনিক বাংলা নাটকের উষাকালে আলোচিত হয়েছে সুকুমার রায়ের ‘চলচ্চিত্ত চঞ্চরি’। সমাজ বাস্তবতা ও সমাজবিকাশের ধারা এই দুই মুখ্য প্রভাবশালী উপাদান আছে তাঁর প্রহসনটিতে। নতুন ঝংকার তুললেন মন্মথ রায়। মন্মথ রায়ের উদয়ের সাথে সাথে বাংলা নাট্য আঙিনায় সম্পূর্ণ এক নতুন পবন বয়ে গেল। বিস্তৃত পূর্ণাঙ্গের বদলে তিনি আনলেন একাঙ্ক। গ্রন্থে আলোচিত তাঁর কারাগার নাটকটিতে ‘কারাগার’ এর দেওয়ালে দেওয়ালে তাদের আর্তি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যারা শৃঙ্খলিত-যেন বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শেকলে ভারতাত্মা গুমরিয়ে উঠেছে। আধুনিক বাংলা নাটক মুখ্যত সমাজ সচেতনতার ধারাবাহিকতাটি রক্ষা করলেও কাব্যকল্পনা আরও গভীরতর বাস্তবতার সন্ধানে ডুবুরি হতে চায়। যা দেখতে পাই বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাট্যে। তাঁর ‘প্রথমপার্থ’ নাটক এক অদ্ভুত কাব্যময় ডালপালায় মোড়া। এ নাটকের বহুস্তরে রয়ে গেছে অসংখ্য নিহিতার্থ। নবনাট্য আন্দোলনের নাটক হিসেবে নাম করা যেতে পারে বনফুলের ‘শিককাবাব’। নবনাট্যের নবতরঙ্গে ভেসে এল জমিদার শ্রেণির হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা ও দরিদ্র নারীদের সামাজিক দুর্গতি।