ইহাতে সন্দেহ নাই যে, দুনিয়া ও আখেরাতে সার্বিক কল্যাণ ও শান্তি লাভের জন্য যেসব উপকরণ রহিয়াছে, তন্মধ্যে একমাত্র একান্ত মনের দোয়াই এমন একটি পদ্ধতি যাহার মাধ্যমে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রেই সার্বিক সাফল্য ও কল্যাণ অর্জিত হইতে পারে। এজন্যই পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে বার বার করিয়া দোয়ার ফযীলত বর্ণিত হইয়াছে এবং তজ্জন্য উৎসাহ প্রদান করা হইয়াছে। অনেক খোদা-প্রেমিক বুজুর্গ মন্তব্য করিয়াছেন: আমরা যাহা কিছু লাভ করিয়াছি, দোয়ার বদৌলতেই লাভ করিয়াছি। বিভিন্ন দোয়ার মধ্যে "দোয়ায়ে মা'ছুরা" যে বিশেষ বরকত ও মর্যাদার অধিকারী, তাহা বলাই বাহুল্য। কারণ এইসব দোয়া আল্লাহ্ তা'আলা সরাসরি পবিত্র কোরআন কিংবা হাদীসে কুদ্স্সীর মাধ্যমে শিক্ষা দান করিয়াছেন, অথবা ওহী যোগে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর জবান মোবারকের মাধ্যমে বাতলাইয়াছেন কিংবা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর নিকট হইতে সরাসরি শুনিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ফলে এইসব দোয়ার মর্যাদা ঠিক তদ্রূপ, যেমন সর্বোচ্চ শাসনকর্তা একজনকে তাঁহার দরবারে পেশ করার জন্য আর্জির মুসাবিদা নিজেই বাতলাইয়া দেন-যাহা মঞ্জুর হওয়ার ব্যাপারে কোন রূপ সংশয়ের প্রশ্নই উঠে না।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।