রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সর্বদা-সর্বত্র বাঙালির ‘বিশেষ’। বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী ও উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। ১৯১২ সালের জুলাই মাসে গ্রন্থাকারে আবির্ভূত হয় জীবন স্মৃতি। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অংকিত চব্বিশটি চিত্রে শোভিত হয়ে। অবশ্য ধারাবাহিক রূপে তার আত্মপ্রকাশ আরও আগে প্রবাসীর পাতায়। কবিগুরুর নিজের ভাষায়, ‘এই লেখাটি জীবনী নহে। ইহা কেবল অতীতের স্মৃতিমাত্র।’ নিজের প্রথম আত্মস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ যেন পাঠকের মনের মধ্যে অদৃশ্য এক মানচিত্র এঁকে দিয়েছেন। যাতে জ্বলজ্বল করে ওঠে উপনিবেশায়িত এক ভারতবর্ষ। বিলেতের হাতছানি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। শহর কলকাতা, বোম্বে, লন্ডন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুরন্তপনার, প্রেম-বিরহ এবং সাহিত্য সাধনার অমল কাব্যিক এক স্বীকারোক্তি। স্মৃতিগদ্য তিনি আরও লিখেছেন। আত্মপরিচয়, ছেলেবেলা। বাঙালির ব্যক্তিত্ব, বিশ্ব ব্যাপ্ত হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথে, আর রবীন্দ্রনাথের জগৎ-নিসর্গ কী রূপে আকার দেয় আধেয়কে, ছায়া ঘনাইয়া তোলে- এসবেরই প্রথম একান্ত খতিয়ান জীবন স্মৃতি। পেছন ফিরে চাওয়ার যে অনুষঙ্গটি পাঠককে খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ- তাই তো আজও আমরা তাঁর কাছে ফিরি। আর বাঙালির সেরা তারকা ভানুসিংহও আত্মকথায়, রচনার প্রসাদে আমাদের আজও ফিরিয়ে নিয়ে যান সেই সময়, কাল ও বাস্তবতায়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।