ভাষা, সাহিত্য, সংগীত থেকে আরম্ভ করে অভিনয়, চিত্রকলা, কারুকলা, স্থাপত্য ইত্যাদি নানা উপাদানে গঠিত সংস্কৃতির অবয়ব। ধর্ম, সামাজিক মূল্যবোধ, লোকাচার, লোকবিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, চলন-বলন, ব্যবহার্য উপকরণ এবং হাতিয়ার- সবই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে যেসব রচনা এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে এসব বিচিত্র দিক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা করা কঠিন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ- এসবের মধ্যে বাঙালিত্ব কোথায়, এই সংস্কৃতির সূচনা কখন থেকে, বাঙালির বৈশিষ্ট্য কী- সে সম্পর্কেও সম্যক ধারণা করা যায় না। বাঙালি সংস্কৃতি মূলত সমন্বয়বাদী। এ দেশের ধর্ম বাঙালি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কিন্তু প্রকাশিত রচনাগুলো হিন্দু বাঙালি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কিন্তু প্রকাশিত রচনাগুলো হিন্দু বাঙালি অথবা মুসলিম বাঙালির সংকীর্ণ সীমানা দিয়ে খণ্ডিত। রাজনৈতিক ভেদরেখাও কোথাও কোথাও আলোচনাকে ঘোলাটে এবং আবিল করেছে। বর্তমান গ্রন্থ বাঙালি সংস্কৃতির প্রথম নিরপেক্ষ এবং পূর্ণাঙ্গ আলোচনা। সরল ভাষায় সাধারণ মানুসের জন্যে লেখা। এতে দেখানো হয়েয়ে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতির প্রতিটি উপাদানের বিবর্তন এবং বহিঃপ্রকাশ; সেই সঙ্গে এই সংস্কৃতির গঠন ও বিকাশে ব্যক্তির অবদান। সবার ওপর আছে বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য উন্মোচন।
বাংলাদেশের গবেষণামূলক বই লেখকদের ক্ষেত্রে অন্যতম নাম ‘গোলাম মুরশিদ’। ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তাঁর জানাশোনার পরিসর অত্যন্ত বিস্তৃত এবং এক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতাও উল্লেখযোগ্য। বছরের পর বছর ধরে তিনি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ রচনা করে গেছেন, তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইটিতে বাঙালি সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝে থাকি এবং যা আমাদের জানার গণ্ডির বাইরে, তার সবটাকেই এক মলাটে বাঁধাই করতে পেরেছেন তিনি। ১৯৪০ সালে বরিশালে জন্ম নেন এই গবেষক ও লেখক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবনে বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়; গবেষণার ছাড়াও বেতার সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। ১৯৮৪ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন। গবেষণার মাধ্যমে অতীতকে আবিষ্কারের নেশা তাঁর প্রবল। গোলাম মুরশিদ এর বই সমগ্র পড়লে বাংলা সাহিত্যের কিছু লেখকের সমৃদ্ধ জীবনকাহিনীও জানতে পারা যায়। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ কিংবা মাইকেল মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে লেখা ‘আশার ছলনে ভুলি’ বইগুলো এর অন্যতম উদাহরণ। নারীপ্রগতি নিয়েও তাঁর একটি বই রয়েছে- ‘রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া’। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন বিষয়কে একটি বিশ্লেষণাত্মক ও গবেষণামূলক ইতিহাসখণ্ডে রূপ দিতে সিদ্ধহস্ত লেখক গোলাম মুরশিদ। গোলাম মুরশিদ এর বই সমূহ শুধু যে ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়েও তাঁর ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে এবং সে আগ্রহের ফসল হিসেবে বাংলাভাষী পাঠকসমাজ পেয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস’। এ বইয়ে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময় পরিক্রমার একটি বস্তুনিষ্ঠ ছবি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন লেখক।