সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) 'তরঙ্গভঙ্গ' (১৯৬৫) নাটকটি 'একটি বিচারকের কাহিনী' নামে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা 'সংলাপ'-এ দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল। নাটকের নায়িকা আমিনা তার স্বামী ও শিশু-সন্তানকে হত্যা করেছিল-সেই বিচারের রায় দিতে বিচারকের বিলম্ব হবার কারণ মানসিকভাবে নায়িকার মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে তাঁর অন্তগূঢ় চিন্তন। নাটকটির চরিত্রসমূহের মধ্যে জজ, মৌলবী আবদুস সাত্তার, উকিল, ভিখারিনী, মতলুব আলী, যুবক, আসামি আমেনা ও বারিশ পীর এবং কেরানি, চাপরাসি ও গ্রামবাসী উল্লেখযোগ্য। মৌলবী আবদুস সাত্তার হলো নায়িকা আমিনার বিরুদ্ধে ফরিয়াদি বা অভিযোগকারী অর্থাৎ বাদী। মৌলবী সাহেবই স্বামী ও সন্তান হত্যাকারী আমেনাকে আসামি হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফরিয়াদি হিসেবে তার বিচার চেয়ে তার ফাঁসি কার্যকরের চেষ্টা করেছে। আমেনা দারিদ্রর ও মনস্তাত্ত্বিক গভীর কোন কষ্টের কারণে স্বামী ও শিশু-সন্তানকে হত্যা করে নির্বাক হয়ে গিয়েছে। নাটকে আমেনার একটি সংলাপও নেই। সে যে দুজনের হত্যাকারী শুধু এ বিষয়টির স্বীকারোক্তি আছে। বেদনায় স্তব্ধবাক আমেনা এই নাটকের নায়িকা চরিত্র হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, নির্বাক ও স্তব্ধ হয়ে যাওয়া এ নারীর জৈবনিক বেদনার পরিপ্রেক্ষিতকে নাট্যকার নির্বিকার শৈল্পিকত্বে তাঁর নাটকে উপস্থাপন করেছেন। আমেনা নাটকের নায়িকা। কিন্তু সে স্বামী ও সন্তান হত্যার জন্যে আসামি হিসেবে আদালতে উপস্থিত। আমেনার স্বামী কুতুব শেখের তিন ভাই আমিনাকে আসামি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। মৌলবী আবদুস সাত্তার নেওলাপুরীও তার লেবাসকে ব্যবহার করে আমেনার ফাঁসি যাতে কার্যকর হয় সে ব্যাপারে ব্যাপক প্রচেষ্টাপ্রবণ ছিল। বিচারক, যিনি জজ চরিত্র হিসেবে নাটকে উপস্থাপিত-তিনি গভীর চিন্তার কারণে হুট করে এ ব্যাপারে রায় দিতে চায়নি। রায় যখন পড়া হবে-তখনই নাটক শেষ হয়। রায় যে কি হল-তা-ও নাটকে বলা হয়নি। আসামি আমেনাকে তাঁর স্বামী কুতুব শেখের তিন ভাই ও গ্রামবাসী অন্যান্যরা মিলে মেরেই ফেলেছে-এহেন কাহিনিও নাটকে অভিব্যক্ত আছে। স্বামী রুগ্ন ছিল। স্বামীর অসুস্থতার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ধুতুরার বিষ খাইয়ে আমেনা তাকে হত্যা করেছে। আমেনা ধনী ঘরের মিঞাদের বাড়িতে কাজ খুঁজতে
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।