“প্রতিকৃতি" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ অঙ্কন-শিল্পে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, বইয়ের প্রচ্ছদ রচনায়, চিত্রনাট্যের পাণ্ডুলিপিতে কিংবা তাঁর নিজের লেখা গল্প-উপন্যাসের ইলাসট্রেসনে। তাই চিত্রশিল্পী সত্যজিতের পরিচয় দেওয়া বাহুল্যমাত্র। তবু স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করতেই হবে। তাঁর আঁকা শতাধিক পােট্রেট বা প্রতিকৃতি চিত্রাবলীর কথা। সারা জীবনব্যাপী বিচিত্র কর্মকাণ্ডের সত্রে সংস্পর্শে আসা দেশ-বিদেশের নানা মনীষী কীর্তিমান ব্যক্তিত্বকে তিনি ধরে রেখেছিলেন রেখাচিত্রে । কখনও প্রয়ােজনে, কখনও সৃষ্টির প্রেরণায়, কখনও শিল্পের তাগিদে। রবীন্দ্রনাথ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ থেকে মকবুল ফিদা হুসেন, বিবেকানন্দ থেকে সুভাষচন্দ্র, শেকসপীয়ার থেকে এলিয়ট, চার্লি চ্যাপলিন থেকে কুরােসাওয়া এবং আরও অনেকে। মাত্র কয়েকটি রেখায় ফুটে উঠেছে চরিত্র। ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী আঙ্গিক বদলেছে প্রায় প্রত্যেক ছবিতে। নানা রকমে, নানা ভঙ্গিতে, নানা শিল্পমাধ্যমে ও শিল্পরীতিতে এ যেন আর এক অসীম অনাবিষ্কৃত সত্যজিৎ-প্রতিভার জগৎ ।। পিকাসােকে দেখি কিউবিজম-এর রেখাচিত্রে। বিবেকানন্দ ধরা দেন শুকনাে ব্রাশের মােটা সরু বলিষ্ঠ টানে। নানা রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কৃত হন নানা দৃষ্টিকোণে। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায় ধরা দেন। কলমের সুনির্বাচিত কয়েকটি সরল টানে, কিন্তু। কবি জীবনানন্দের মুখাবয়বের ক্ষেত্রে চলে আসে। অন্য ছন্দ—যে ছন্দ তাঁর কবিতায়। তাঁর। গােলাকার মুখাবয়ব, অলৌকিক অজ্ঞাত রহস্যময়। চাউনিকে ফুটিয়ে তােলেন অসংখ্য কুচো লাইনের সমাবেশে । রামকিঙ্করের মুখাবয়বে যেন তাঁরই ভাস্কর্যরীতির প্রয়ােগ। আবার শিবনাথ শাস্ত্রী। আঁকার সময় অঙ্কনরীতি অনুসরণ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর কাঠখােদাইয়ের কারিগরি শৈলী। নির্বক মুখের ব্যঙ্গাত্মক চোখের চাউনি তুলির টানে এসে। যায় চার্লস চ্যাপলিন এর মুখাবয়ব। চলচ্চিত্রের বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও এই সৃষ্টি যেন অন্য সব মহামনীষার প্রতি এক নতমস্তক শ্রদ্ধার্ঘ্য। প্রতিকৃতি রূপাঙ্কনের এই আশ্চর্য সিদ্ধি শুধু মুগ্ধই করে না, প্রাণিত করে অন্যতর শিল্প-ভাবনায়। এই গ্রন্থে প্রায় হারিয়ে-যাওয়া সেইসব অবিস্মরণীয় প্রতিকৃতিগুলি উদ্ধার করা হয়েছে। চারটি প্রতিকৃতি প্রকাশিত হল এই প্রথম। হয়তাে আরও কিছু থেকে গেল আমাদের সন্ধানের বাইরে। তবু বলা যায়, এই সংকলন ধরে রাখল বহুমুখী সত্যজিৎ-প্রতিভার আর একটি বিরল। দিক। তাঁর এই অমূল্য সৃষ্টি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। কেউ কেউ জানতেন, কিন্তু সবাই নন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই প্রতিকৃতিগুলিকে বহুদিনের পরিশ্রমে সংগ্রহ করে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন সৌম্যেন পাল। অনন্য সত্যজিৎকে নতুন নতুন করে পাওয়ার এই আয়ােজন আমাদের আরও একবার ঋদ্ধ করল।
সত্যজিৎ রায় এক বাঙালি কিংবদন্তী, যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিশ্বদরবারে। কর্মজীবনে একইসাথে চিত্রনাট্য রচনা, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, সম্পাদনা, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ, লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন অসম্ভব গুণী এই মানুষটি। ১৯২১ সালে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যচর্চায় খ্যাতনামা এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে রয়েছে তাঁর পৈত্রিক ভিটা। ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ বা ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিলো যে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র জন্যই পেয়েছিলেন ১১টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যার মধ্যে অন্যতম হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ পুরস্কার। তবে তাঁর কাজের সমালোচকও কম ছিলো না। এসব সমালোচনার উত্তরে লেখা দুটি প্রবন্ধ পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায় এর বই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’-তে। কল্পকাহিনী ধারায় সত্যিজিৎ রায় এর বই সমূহ জয় করেছিলো সব বয়সী পাঠকের মন। তাঁর সৃষ্ট তুখোড় চরিত্র ‘ফেলুদা’, ‘ প্রফেসর শঙ্কু’ এবং ‘তাড়িনী খুড়ো’ যেন আজও জীবন্ত। একের পিঠে দুই, আরো বাড়ো এমন মজার সব শিরোনামে বারোটির সংকলনে লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। এছাড়াও সত্যজিৎ রায় এর বই সমগ্র’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চলচ্চিত্র বিষয়ক ‘একেই বলে শ্যুটিং’, আত্মজীবনীমূলক ‘যখন ছোট ছিলাম’ এবং ছড়ার বই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একাডেমি সম্মানসূচক পুরষ্কার' (অস্কার) প্রাপ্তি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।