প্রকৃতি প্রেম, মানব প্রেম, ধর্ম প্রেম, বিশ্ব প্রেমও রবীন্দ্রনাথকে আধ্যাত্মিক করে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আত্মপরিচয়’ রচনায় মানুষের নিজের ভেতরকার ধর্মকে নিজ চোখে দেখার কথা বলেছেন। মনের ভেতরে গোপনে থেকে মানুষকে সৃষ্টি করে তোলে তাই তো তার ধর্ম। কোনো ব্যক্তির কোষ্ঠীতে বা নামপত্রে যে ধর্মের উল্লেখ আছে কিংবা জন্মসূত্রে যে ধর্ম বিশ্বাসপ্রাপ্ত হয়েছেন সেটা তার প্রকৃত ধর্ম নাও হতে পারে। ব্যক্তির জীবনদর্শন বা চরিত্রের ভেতর থেকে উঠে আসে যথার্থ ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচেতনায় অনুশাসন বা শাস্ত্র আশ্রিত ধর্মচেতনা সক্রিয় ছিল না। তবে তার ধর্মবোধ বিবর্তিত হয়েছে। প্রথম থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত ধর্মীয় আদর্শ, ধর্মচিন্তা সব মিলিয়েই কবির আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে মানুষ শুচি হয়ে ওঠে। বড়ো হওয়ার ইচ্ছা, মহৎ হওয়ার ইচ্ছাই আধ্যাত্মিকতা ধর্মসাধনা করলে হৃদয় কোমল হয়, চারিত্রিক তীব্রতা মাধুর্যে পরিণত হয়। ধর্মসাধনার অন্তরালে সুন্দর লুকিয়ে থাকে। তাকে আবিষ্কার করতে হলে ধ্যান, উপাসনা, প্রার্থনা দরকার। এসবই রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। জীবন-সন্ধ্যায় পৃথিবীর পথ যখন ফুরিয়ে এসেছে, কবি নিশ্চিন্তে বেরিয়ে এসেছেন অভিসারে‘একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে।’ আর এ অভিসারেই পাশ্চাত্য জগতে পরিচিত ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ তার সমস্ত গীতের অঞ্জলি দিলেন স্রষ্টাকে। এখন তা কালজয়ী গীতাঞ্জলি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।