জাপান একটি বিস্ময়কর দেশ! এই ধারণাটি আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই যা ছিল না বাংলাদেশে তা জাপানে বিদ্যমান। অর্থাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, উন্নত খাবারদাবার এবং আধুনিক প্রযুক্তির কারণে এশিয়ার আমেরিকা বলে বিদেশিদের মুখে শুনেছি, পত্রপত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু আমার কাছে উন্নত প্রযুক্তির কারণেই নয়, তার সঙ্গে যুক্ত জাপানিদের আধ্যাত্মিকতা, সুকুমার বৃত্তি এবং অগ্রসর চিন্তাচেতনা। এসব কারণে এই দেশটিকে আমার অনন্য, অসামান্য এবং প্রেরণাদায়ী মনে হয়েছে। আশি দশকের শেষদিকে যখন একদিন জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক, বাংলা ভাষা ও বাঙালিপ্রেমী একজন জাপানি নাগরিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ হলো, সেদিন জাপানের প্রতি ভালোলাগার মাত্রাও সহসাই কয়েক গুণ বেড়ে গেল। আমার একাকীত্ব ও শূন্যতা কেটে গেল। সেই বিদগ্ধ নাগরিক অধ্যাপক কাজুও আজুমার সঙ্গে অকস্মাৎ সাক্ষাৎ ও কথপোকথন জাপান সম্পর্কে আমার ধারণাকেই বদলে দিল। মনে হলো জাপান আমার অনাত্মীয় নয়, আপন একটি রাষ্ট্র। আর তা মনে হয়েছিল উক্ত অধ্যাপক যখন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে উচ্চধারণা পোষণ করে জাপান ও বাংলা অঞ্চলের মধ্যে বহু বছরের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাববিনিময়ের কথা বললেন। আমি অবাক হয়ে শুনলাম তার কথা এবং প্রবল আগ্রহ জন্মাল জাপান দেশটি সম্পর্কে। ভারতবর্ষ ও বাংলা অঞ্চলের সঙ্গে জাপানের গভীর সম্পর্ক অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক বুঝতে সক্ষম হলাম, যখন গ্রন্থাগারে গিয়ে তৎসম্পর্কিত বিস্তর তথ্যাদির সন্ধান পেলাম। তারই প্রচেষ্টার ফসল হলো “জানা আজানা জাপান” প্রবন্ধ সংকলনের প্রথম খণ্ড। ১৯৮৭ সাল থেকেই জাপান সম্পর্কে জানা ও বোঝার চেষ্টাস্বরূপ লেখালেখি শুরু করেছিলাম। প্রথমদিকে বাংলাদেশের দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাগজে এবং পরবর্তীকালে আমার সম্পাদিত “মানচিত্র” কাগজে বেশকিছু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হলো। সেসব রচনায় জাপানের আলোকিত দিক যেমন রয়েছে, তেমনি মন্দ দিকও বিদ্যমান। মন্দের চেয়ে ভালো দিকই অধিক এবং শিক্ষণীয়, অনুকরণীয় বলে আমার জোরালোভাবেই মনে হয়েছে। ২০০৭ সালে বিশটি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ বাছাই করে প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। কিন্তু প্রচুর মুদ্রণজনিত ভুল ও বিভ্রান্তির কারণে গ্রন্থটি বাজারজাত করা হয়নি। পরের বছর ঢাকা থেকে স্বব্যয়ে পুনরায় প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে পাঠকমহলে। এশিয়ার প্রথম শিল্পোন্নত ধনী রাষ্ট্র জাপানের প্রতি বাঙালির প্রবল আগ্রহ উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকার উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে, কিন্তু জাপানের বহু অজানা দিক ও বিষয় সম্পর্কে ভারতবাসী বা বাঙালির কোনো ধারণাই ছিল না যেমনটি আমারও। সেসব বিষয় নিয়েই আমার রচনাসমূহ আলোড়ন তুলেছিল পাঠকমহলে। অনেক বিদগ্ধ পাঠক, গবেষক, লেখক, চিন্তাবিদ এবং সাংবাদিকের কাছ থেকে পেয়েছি আন্তরিক প্রশংসা ও উষ্ণ সাধুবাদ। প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন সময় সময় বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে লিখেছি ফলে তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যা এড়ানো এককথায় অসম্ভব। পাঠকের বিরক্তির কারণ হলে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমার পরম সৌভাগ্য যে, দীর্ঘ বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে পুনরায় প্রথম খণ্ডটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে উদীয়মান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই প্রকাশককে।