কেমন ছিল প্রিয়নবীর আলাপচারিতা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি কাজেই ছিলেন আদর্শস্বরূপ। তার সুবাসিত জীবনচরিত অধ্যয়ন করে আমরা জেনেছি, তিনি কথোপকথনেও ছিলেন উত্তম আদর্শ। তাই আমাদের নবীজির মতো কথা বলতে শেখা উচিত। কোথাও দুজন মানুষকে কথা বলতে দেখলে দেখা যায়, তারা কথা বলছেন শিষ্টাচার ছাড়িয়ে, হয়তো উচ্চৈঃস্বরে-যা চারপাশের মানুষকে বিরক্ত করে, অথবা এত নিম্নস্বরে যে তার সঙ্গীটিও শুনতে পায় না। আলাপচারিতার ক্ষেত্রে ইসলামের কিছু শিষ্টাচার রয়েছে, আমরা তা জানব প্রিয়নবীর আলাপচারিতা থেকে।
রহমতের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় অবস্থিত মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের অঙ্গসংস্থা 'আল-বারনামাজুল আলামিয়্যু লিত-তারিফ বি-নাবিয়্যির রহমাহ-এর অধীনে আন্তর্জাতিক এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়া ও মহানুভবতার পরিচয়দানবিষয়ক সেই প্রতিযোগিতার শিরোনাম দেওয়া হয় مظاهر الرحمة للبشر في شخصية النبي صلى الله عليه وسلم অর্থাৎ মানবজাতির প্রতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়া ও মহানুভবতার দিকসমূহ। এই প্রতিযোগিতায় পঁচিশটি দেশের চারশ ত্রিশজনের গবেষণাপত্র জমা হয়। তার মধ্যে প্রথম পুরস্কার অর্জন করে এই গ্রন্থটি। ড. রাগিব সারজানির পক্ষ থেকে এই প্রয়াস ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়া ও মহানুভবতার যথাযথ উপস্থাপনের লক্ষ্যে, যাতে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তাঁর দয়া ও মহানুভবতা সম্পর্কে অবগত হয়ে জীবনের সঠিক দিক নির্ণয়ে সচেষ্ট হয়। নিজের অন্যান্য বইয়ের মতো এ রচনাতেও ড. রাগিব সারজানি তার শতভাগ নিজস্বতা বজায় রেখেছেন। কেবল ইতিহাসে নয়, বরং সিরাতের ক্ষেত্রেও বিস্তর আলোচনায় তিনি কতখানি প্রাজ্ঞজন, পাঠক প্রমাণ পাবেন তার এ সুবিন্যস্ত গ্রন্থনায়।
নবিজির প্রতি ভালোবাসা দুনিয়াতে কেউ কারও ওপর এক-দুবার অনুগ্রহ করলেও অনুগ্রহধন্য ব্যক্তি তার অনুগ্রহদাতাকে ভালোবেসে ফেলে। তদ্রূপ কেউ আমাদেরকে কোনোরূপ ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর বিষয় থেকে বাঁচালে তাকেও আমরা ভালোবাসতে শুরু করি, মহব্বত করি। অথচ জাগতিক সেই অনুকম্পা যত বেশিই হোক অথবা ক্ষতি থেকে যত দিনই বাঁচিয়ে রাখা হোক কিন্তু তা কখনোই চিরস্থায়ী হতে পারে না। এবার তবে বলুন, উত্তম চরিত্রগুণ ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহের আধার, মহান ও সম্মানিত সত্তা আমাদের নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাপ্য কী হতে পারে যিনি আমাদেরকে সর্বব্যাপী মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত করেছেন?! আল্লাহ তায়ালা তার মাধ্যমেই তো আমাদেরকে কুফরির অন্ধকার থেকে মুক্ত করে ইমানের আলোতে উদ্ভাসিত করেছেন। তাঁর মাধ্যমেই তো আমরা অজ্ঞতা ও জাহেলিয়াতের জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহর প্রতি ইয়াকিন ও তাঁর পরিচয়ের অন্তর প্রশান্ত-করা জান্নাতি পরিবেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছি
উসওয়াতুল লিল আলামিন গ্রন্থটিতে রয়েছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিচয়, সমগ্র মানবজাতির হেদায়েতের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের মূল্যায়ন এবং বিশ্ববাসীর প্রতি তাঁর নির্দেশনা ও দীপ্তি প্রসারের অভিপ্রায়। পৃথিবীতে আগত শ্রেষ্ঠ মানব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যঙ্গবিদ্রুপে নিমজ্জিত পাশ্চাত্য জাতির মুক্তির অভিপ্রায়ে, মিশরের 'আল মারকাজুল ইসলামি আল-আম লিদুআতিত-তাওহিদ ওয়াসসুন্নাহ'-এর অধীনে আন্তর্জাতিক এক (সিরাত) প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিচয়দান-বিষয়ক সেই প্রতিযোগিতার শিরোনাম দেওয়া হয় فلتعرف هذا النبي' বা 'জেনে নিন এই নবীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশে ঘোষণা প্রচার করা হয়। এই প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত বাছাই পর্বে বিভিন্ন ভাষায় রচিত একশ আশিটি গবেষণাপত্র নির্বাচিত হয়। আর যে গবেষণাপত্রটি প্রথম পুরস্কার অর্জন করে তা হলো আমাদের এই 'উসওয়াতুল লিল আলামিন' নামের বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি। অন্য কোনো গবেষণাপত্র এর সমমান বা কাছাকাছি মানের না হওয়ায় প্রতিযোগিতা পরিচালনাপর্ষদ দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার বাতিল বলে ঘোষণা করেন। বইয়ের রচয়িতা ড. রাগিব সারজানির পক্ষ থেকে এই প্রয়াস ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যথাযথ পরিচয় উপস্থাপনের লক্ষ্যে। যাতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষ তাঁর মহানুভবতা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভ করতে পারে।
রুহামাউ বাইনাহুম মানুষ শুধু নিজের জন্যই বাঁচে না। বরং একটি সার্থক জীবন ব্যয়িত হয় অন্যদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সত্য হলো, দুনিয়ার সকল মানুষের সুযোগ, সংগতি, মেধা ও সক্ষমতা এক নয়। কত কত মানুষ আপতিত হয়ে আছে কতরকম কষ্ট ও পরীক্ষায়। তা ছাড়া মানুষ হিসেবেও কেউ পূর্ণ ও সম্পূর্ণ নয়। তাই পৃথিবীতে প্রয়োজন পারস্পরিক সাহায্য ও সহানুভূতি। এবং বঞ্চিত ও অভাবীদের অধিকার প্রদান করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের তেমনটাই আদেশ করেন। এটাও একটি ইবাদত। ড. রাগিব সারজানি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে জগতের সামনে মুসলমানদের পারস্পরিক সাহায্য-সহানুভূতির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন-অতি দরদ ও ব্যথার সাথে, চমৎকার বিন্যাস ও উদাহরণের সাথে। হৃদয়স্পর্শী বহু গল্প বা ঘটনার সাথে। আশা করা যায়, গ্রন্থটি আমাদেরকে ব্যাপকভাবে জাগরিত করবে। পুণ্যবানদের বর্ণনা-স্পর্শে অন্তর হবে উন্নত বিগলিত এবং অনুপ্রাণিত। চোখের সামনে খুলে যাবে অতীত মুসলমানদের পারস্পরিক সাহায্য-সংহতি ও সহানুভূতির এক সুরভিত জগৎ। অসম্ভব কী! আমাদের মাঝেও ফিরে আসুক অতীতের সেই সোনালি বিভা- কল্যাণ-কর্মের নমুনা
মানবীয় দুর্বলতায় নবিজির মহানুভবতা এই বইয়ে আমরা নবিজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহানুভবতার প্রশংসনীয় ও অকৃত্রিম একটি দিক তুলে ধরব। আলোচনা করব বিভিন্ন মানবীয় দুর্বলতার সাথে নবিজির আচরণ-মাধুর্য নিয়ে। আমরা দেখতে পাব, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতিটি কথায় ও কাজে দুর্বলদের প্রতি অসীম দয়া ও অনুগ্রত ফুটে উঠছে। নবি-জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যাতে দয়া ও ভালোবাসা ছড়িয়ে নেই। ভর্ৎসনা ও তিরস্কারে, শাস্তি প্রদানে; এমনকি যুদ্ধের মতো মুহূর্তেও আমরা দেখব দয়ার অনুপম দৃষ্টান্ত। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পুরো জীবনে এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এ এমন সর্বজন-স্বীকৃত বিষয়, যাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। দুর্বলদের সাথে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দয়ার্দ্র আচরণের সুন্দর এই চিত্রগুলো পাঠ করার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, এই চিত্রগুলো আঁকা হয়েছিল এমন সময়ে, যখন দুর্বলদের অধিকারের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করা হতো না। সে সময়রে অহংকরী লোকেরা কারও কোনো দুর্বলতা দেখলে, তার উপর আরও বেশি অত্যাচার করত। যদি আমরা এই প্রেক্ষাপট মনে রাখি, তাহলে বুঝতে পারব, এই বইয়ে আমরা এমন একজন নবি সম্পর্কে পাঠ করছি, যিনি সত্যিই সমগ্র বিশ্বের নেতা হওয়ার যোগ্য।
আরবের চাঁদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যিনি হেদায়েতের চাঁদ হয়ে উদিত হয়েছিলেন আরবের আকাশে। তবে সেই চাঁদের আলো কেবল আরবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। সেই মরুচাঁদের বিভায় বিমোহিত হয়ে স্বামী লক্ষ্মণ প্রসাদ রচনা করেছেন আরবের চাঁদ নামে এক অনবদ্য গ্রন্থ। যার প্রতিটি পৃষ্ঠা তিনি সাজিয়েছেন রাসুলপ্রেমের বর্ণমালায়। কখনো-বা আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন ভারতবর্ষের করুণ বর্তমান দেখে। এ অঞ্চলটির নানা অসংগতির কথা উল্লেখ করে লেখক বলেন, "আজকের এই শিক্ষিত ও সভ্য হিন্দুস্তানের সঙ্গে জাহেলি যুগের আরবের যে কতটা গভীর মিল রয়েছে, তা আমাদের হিন্দুস্তানিদের জীবনব্যবস্থার দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষেরই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, পছন্দ-অপছন্দ থাকে এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমার দৃষ্টিতে বর্তমান সময়ে আমাদের প্রিয় হিন্দুস্তানের সামনে যে মহান মনীষীর আদর্শ ও জীবনীকে পেশ করা যেতে পারে, তিনি হলেন নবী-রাসুলদের সর্দার মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম"।
Dr. Rageb Sarjani জন্ম: ১৯৬৪ঈ. আল মুহাল্লা কুবরা, মিশর। ড. রাগেব সারজানী মিশরের বিশিষ্ট ইসলামপ্রচারক, ইতিহাসবিদ ও একজন আধুনিক আরবলেখক। পেশায় মূলত তিনি একজন ডাক্তার। তবে ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি ইসলামী ইতিহাসের গভীর গবেষণা বর্তমান পৃথিবীতে তাকে একজন বিশিষ্ট ইসলামী ইতিহাসবিদ হিসেবে পরিচিত করেছে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর পবিত্র কুরআনুল করীম হিফজ করেন। ইসলামের প্রতি আস্থা ও ভালোবাসা, ইসলামের ইতিহাসের প্রতি দরদ ও শ্রদ্ধা-তার চোখের তারায় যে আগামীর স্বপ্ন আঁকে-সেই স্বপ্ন বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতেই তার লেখালেখি। এই স্বপ্ন ছবি হয়ে উড়ে বেড়ায় তার রচনার ছত্ৰে ছত্ৰে | শিক্ষা তিনি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদ থেকে ইউরোসার্জারি বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র কুরআনুল করীম হিফজ করেন। কর্মক্ষেত্র অধ্যাপক : মেডিসিন অনুষদ, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়,সদস্য : ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম উলামা পরিষদ,সদস্য : মানবাধিকার শরীয়া বোর্ড, মিশর,সদস্য : আমেরিকান ট্রাস্ট সোসাইটি ,প্রধান : ইতিহাস বিভাগ, ইদারাতুল মারকাযিল হাজারা, মিশর রচনাবলি ইতিহাস ও ইসলামী গবেষণা বিষয়ে এ পর্যন্ত তার ৫৬টি মূল্যবান গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য— কিসসাতুত তাতার (তাতারীদের ইতিহাস),কিসসাতু উন্দুলুস (স্পেনের ইতিহাস),কিসসাতু তিউনুস (তিউনেসিয়ার ইতিহাস) আর রহমা ফি হায়াতির রসূল মা'আন নাবনী খায়রা উন্মাতিন প্রভৃতি।