“যখন ছোট ছিলাম" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ এই বইতেই তিনি শুনিয়েছেন একটি ছেলের কথা, ইস্কুল ছাড়ার দশ বছর বাদে যাকে একবার যেতে হয়েছিল পুরনাে ইস্কুলের চত্বরে, আর যেখানে ঢুকেই যাঁর মনে হয়েছিল, এ কোথায় এলাম রে বাবা! দরজা ঘােট, বারান্দা ছােট, ক্লাসরুম আর ক্লাসের বেঞ্চিগুলাে সবই কেমন ছােট মনে। হচ্ছে। পরে তিনি নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন, কেন এই বিভ্রম। ইস্কুল ছাড়ার সময় তিনি ছিলেন পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, আর সেবার যখন ফিরে। গেলেন, তখন তিনি উচ্চতায় প্রায় সাড়ে ছ'ফুট। ইস্কুল তাে বাড়েনি, বেড়েছেন তিনি নিজেই। আমরা অবশ্য জানি, এর পরেও ক্রমশ তিনি আরও কত বড় মাপের হয়ে উঠেছেন। প্রতিভায়, প্রতিপত্তিতে, খ্যাতিতে, জনপ্রিয়তায় ক্রমশই তিনি নিজেকে কীভাবে গিয়েছেন ছাপিয়ে। সেই বড় মাপের মানুষটিই এই বইতে শশানালেন তার খুব পুরনাে দিনের কিছু কথা- ‘যখন ছােট ছিলাম। একদা যিনি আমাদের চলচ্চিত্রকে। রাতারাতি সাবালক করে তুলেছিলেন ‘পথের পাঁচালী উপহার দিয়ে, আজ তিনি নতুন করে যেন শুরু করলেন আরেক পথের পাঁচালী, যে-পথ। গিয়েছে তার নিজেরই সােনালী শৈশবের দিকে। এই নতুন পথের পাঁচালীতেও একটি ছেলের মুগ্ধতা ও বিস্ময়, কল্পনা ও কৌতূহল, কৌতুক ও রােমাঞ্চ, অনুভব ও উপলব্ধি নিয়ে বড় হয়ে ওঠা ছবির মতন আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন তিনি। সেই ছেলেটির নাম— সত্যজিৎ রায়।। এ বইতে শুধু সেই ছােট্ট সত্যজিৎ রায়ের বড় হয়ে ওঠার কাহিনীই শােনাননি তিনি, সেই সঙ্গে শুনিয়েছেন এমন-এক পরিবারের কথা যে-পরিবার বাংলা সাহিত্যে একমাত্র ঠাকুরবাড়ির পরেই স্মরণযােগ্য। আর শুনিয়েছেন এমন এক। কলকাতার কথা, যেকলকাতা আজ মনে হয় অচেনা।
সত্যজিৎ রায় এক বাঙালি কিংবদন্তী, যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিশ্বদরবারে। কর্মজীবনে একইসাথে চিত্রনাট্য রচনা, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, সম্পাদনা, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ, লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন অসম্ভব গুণী এই মানুষটি। ১৯২১ সালে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যচর্চায় খ্যাতনামা এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে রয়েছে তাঁর পৈত্রিক ভিটা। ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ বা ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিলো যে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র জন্যই পেয়েছিলেন ১১টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যার মধ্যে অন্যতম হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ পুরস্কার। তবে তাঁর কাজের সমালোচকও কম ছিলো না। এসব সমালোচনার উত্তরে লেখা দুটি প্রবন্ধ পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায় এর বই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’-তে। কল্পকাহিনী ধারায় সত্যিজিৎ রায় এর বই সমূহ জয় করেছিলো সব বয়সী পাঠকের মন। তাঁর সৃষ্ট তুখোড় চরিত্র ‘ফেলুদা’, ‘ প্রফেসর শঙ্কু’ এবং ‘তাড়িনী খুড়ো’ যেন আজও জীবন্ত। একের পিঠে দুই, আরো বাড়ো এমন মজার সব শিরোনামে বারোটির সংকলনে লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। এছাড়াও সত্যজিৎ রায় এর বই সমগ্র’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চলচ্চিত্র বিষয়ক ‘একেই বলে শ্যুটিং’, আত্মজীবনীমূলক ‘যখন ছোট ছিলাম’ এবং ছড়ার বই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একাডেমি সম্মানসূচক পুরষ্কার' (অস্কার) প্রাপ্তি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।