ভালোবাসা স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী। একজন কাব্যপ্রেমিকের যদৃচ্ছ ভালোবাসার মানচিত্র এই বই। তাই এ মানচিত্র উন্মত্ত। আমি বিশ্বকবিতার প্রেমে অতিক্রম করে গেছি দেশের দেয়াল, কালের পাহারা। এই অনুবাদকবিতাগ্রন্থে পাঠক তাই কোনো বিশেষ দেশ বা কালের ক্রমিক কবিতা বা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়োৎসারিত কবিতার সন্ধান পাবেন না। আমি গ্রহণ করেছি আমার প্রিয় কবিদের, চালিত হয়েছি প্রিয় কবিতার আত্মভাষায় জাগরণে। যাঁরা ধারাবাহিক ইতিহাসের অনুসরণ করতে যাবেন এই সংকলনে, ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হবেন তাঁরা। এই অনুবাদগুচ্ছ অমন কোনো সাধু বা আদর্শিক উদ্দেশ্যের দ্বারা প্রণোদিত নয়; খেলাচ্ছলে রচিত বরং। আশ্চর্য আনন্দের আস্বাদ পেয়েছি অনেক দিন পরে, সহসা মনে হয়েছে কখনো সত্যিকার সাহিত্যিক ভিতরমহল চরিতার্থ হচ্ছে এই অনুবাদঅয়নে। ঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় : হয়তো উচ্চাশাতাড়িত নয় বলে ঐ আনন্দের আস্বাদ, হয়তো বিশেষ সময়ের ছেঁকে-ধরা মেজাজের দীপ্ত উপহার, হয়তো যেমন আমার হয় অনেক সময় নিজের বিরুদ্ধে কাজ করে। নিজের বিরুদ্ধে; অর্থাৎ আমি কবিতানুবাদে ঘোর অবিশ্বাসীমুখে ও লিখে তার বিরুদ্ধতা করেছি এবং গ্রন্থপ্রকাশের মুহূর্তেও তার শেষ-সার্থকতা সম্বন্ধে সন্দিহান। কাব্যানুবাদের ঐ ব্যক্তিগত হর্ষ ও সাহিত্যিক অচরিতার্থতার দু-রঙা রাস্তায় চলতে-চলতে অনুবাদকালীন দুটি নোট থেকে উদ্ধার করে দিই : ১. ‘নৈশচিত্র’ কবিতাটির অন্ত্যমিল ল¶্য না করে দ্রুত অনুবাদ করে যাচ্ছিলাম, অর্ধেক অনূদিত হওয়ার পর অন্ত্যমিলের অস্তিত্ব ল¶্য করলাম, এবং উল্লসিত হয়ে উঠলাম আমার কাজ কারো কঠিন হবে বলে : অনুবাদ্য কবিতা যত কঠিন-জটিল হয় ততো সুখী হয়ে ওঠেন অনুবাদকতখন অনুভব করলাম নিজের ভিতরে প্রতিপ¶ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শব্দ-ছন্দ-বিষয়ের সঙ্গে মোকাবেলা করতে সৃষ্টি ও নির্মাণের মধ্যে সমঝোতা করতে এক আলাদা আনন্দ। ২. [‘সুভাষণ’ কবিতা প্রাসঙ্গিক।] সোল্লাস কবিতায় ছন্দ ও প্রসঙ্গের সমান্তরে হয়ে ওঠে নৃত্যপর। সাধারণ অন্ত্যমিল ও অর্ধ মিল বা একা¶র মিল সচেতনভাবে প্রয়োগ করেছি; অনেক অস্পর্শিত পড়ে আছে একা¶র মিলের দিক থেকে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ (৩ আগস্ট ১৯৪৩ - ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাহিত্য-সম্পাদক। তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের "পোয়েট ইন রেসিডেন্স" ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ষাট দশক থেকে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে তার গবেষণাধর্মী অবদান ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের উপর তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্ম রয়েছে। তিনি ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বেগম রোকেয়া, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদককে নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যমহলে তিনি 'মান্নান সৈয়দ' নামেই পরিচিত ছিলেন।