সুকুমার রায় ও তাঁর কালজয়ী সাহিত্য 'বাপুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে আয় বাবা দেখে যা দুটো সাপ রেখে যা...' কিংবা 'বিষম চিন্তা' শিরোনামের- 'মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছ না কেউ জবাব তার সবাই বলে মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার।...' এরকম কালজয়ী কত যে ছড়া-কবিতার স্রষ্টা তিনি, তার হিসাব করা কঠিন। বাংলা ভাষার সাহিত্যে শিশু-কিশোরদের মনকেড়ে নেওয়া এমন অসংখ্য ছড়া- কবিতা আর ছোটগল্পের লেখক সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩) বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন তাঁর অসাধারণ প্রতিভার গুণেই। সাহিত্যের বহু শাখায় তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর রম্যরচনাবলি, প্রবন্ধ এবং নাটকও বেশ সুখপাঠ্য। বাংলা ভাষায় যে 'ননসেন্স রাইম' তারও জনক তিনি। এই আজগুবি ছড়া-কবিতাগুলো ননসেন্স নয়। এগুলোর মধ্যেও একেকটা মেসেজ বা তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। যেমন- 'রামগড়ুর ছানা' থেকে একটু উদ্ধৃত করা যাক:' 'রাম গড়ুরের ছানা' হাসতে ওদের মানা' হাসব না-না, না-না' সদাই মরে ত্রাসে' ওই বুঝি কেউ হাসে' একচোখে তাই মিটমিটিয়ে তাকায় আশপাশে' রামগড়ুরের বাসা' ধমক দিয়ে ঠাসা' হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়' নিষেধ সেথায় হাসা।'' আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ করি রামগড়ুরের ছানা কোনো বুনো প্রাণী নয়- আমাদের সমাজেরই কিছু মানুষ। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে আমলাতন্ত্রের চরিত্র চিত্রিত করেছেন সুকুমার রায় এই ছড়ায়। ননসেন্স রাইমে তিনি বক্তব্য তুলে ধরেছেন নানা রকম প্রতীকে, ইঙ্গিতে। শুধু বিনোদনও যদি কেউ খোঁজেন তাও পেতে পারেন তাঁর ছড়ায়। শব্দ দিয়ে তিনি চমৎকার সুর সৃষ্টি করেছেন ছন্দে। 'শব্দকল্প দ্রুম' কবিতার উদ্ধৃতি নেওয়া যেতে পারে:' 'ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খঙ্কা- ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্ক্কা! শাঁই শাঁই পল্পন্ ভয়ে কান্ বন্ধ- ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?'
উপেন্দ্ৰকিশোর রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ সুকুমারের জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০৬-এ পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন দুই বিষয়েই অনার্স নিয়ে বি.এসসি পাশ করার পর ১৯১১-য় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুপ্ৰসন্ন ঘোষ বৃত্তি লাভ করে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি বিলেতে যান। লন্ডনে ও ম্যাঞ্চেস্টারে অধ্যয়ন করেন তিনি ও তাঁর গবেষণার জন্য সম্মানিত হন। ১৯১৩-য় উপেন্দ্ৰকিশোরের সম্পাদনায় ছোটদের সচিত্ৰ মাসিক পত্রিকা সন্দেশ’’ প্রকাশিত হয়। সুকুমার দেশে ফেরারী কিছুকাল পরে ১৯১৫-য় উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। সুকুমার ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কার্যালয়ের পরিচালনার এবং “সন্দেশ’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন। “সন্দেশ’-এর পাতাতেই তাঁর অধিকাংশ ছোটদের লেখা-গল্প, কবিতা, প্ৰবন্ধ, ধাঁধা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। শুধু নিজের লেখা নয়, ছবি এঁকেছেন তিনি। “হ য ব র ল’, ‘আবোল তাবোল’ জাতীয় আজগুবি চালের বেঠিক বেতাল ভুলের ভবের গদ্য ও পদ্য রচনা ছাড়াও শিল্প সাহিত্য ভাষা ধর্ম বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সক্রিয় ছিল তাঁর লেখনী। আড়াই বছর কালাজ্বরে ভুগে ১৯২৩-এ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সুকুমার রায় ১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি শুয়ে শুয়ে সন্দেশের জন্য ছবি এঁকেছেন, প্রচ্ছদ রচনা করেছেন, গল্প কবিতা লিখেছেন। আবোল তাবোল’-এর ডামি কপিাটাও রোগশয্যায় তৈরি করেছেন। কিন্তু বইটি ছেপে বেরোবার ন” দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়।