মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি বাঙালির দীর্ঘকালের আত্মানুসন্ধান, আন্দোলন এবং ইতিহাসের অমোঘ প্রক্রিয়ার এক পরিণতি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা ও দ্বি-জাতি তত্ত্বের বাতাবরণ ছিন্ন করে স্বাধিকার অর্জনের জন্য মুক্তিপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ইতিহাসের এসব ঘটনার অবিনাশী দলিল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে যুগান্তরব্যাপী বিশে^র বিভিন্ন দেশ বা জনগোষ্ঠীর নানা প্রজন্মের মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোকজ্জ্বল পথে প্রেরণা দান করে। ইতিহাস প্রতিনিয়ত গণমানুষের আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তন ঘটায়। তদ্প্রেক্ষিতে ইতিহাসের অর্থ, বিশ্লেষণ ও অনুপ্রেরণা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মানুষ নানা মাধ্যম ও উপায়ে ইতিহাসকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। ইতিহাসবিদদের লেখা, চিত্রকলা ও আলোকচিত্রের মাধ্যমে ইতিহাস বর্ণনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। লিখিত ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ও সঠিক বিবেচনা করা হয়। শতাব্দীব্যাপী মানুষ ছাপার অক্ষরকেই সত্য মনে করতো। আধুনিক যুগে ক্যামেরা আবিষ্কারের ফলে ইতিহাসে আলোকচিত্র মূর্ত প্রতীকরূপে বিবেচিত হয়। আলোকচিত্রে উপস্থাপিত ইতিহাসকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণিক দলিলস্বরূপ বিবেচনা করা হয়। চিত্রকলা ও দেয়ালচিত্র ইতিহাস সংরক্ষণের প্রাচীন মাধ্যম। বর্তমান বিশ্বের ইতিহাস বা স্মৃতি সংরক্ষণে আলোকচিত্র অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচিত। ঐতিহাসিক ঘটনা আলোকচিত্রের মাধ্যমে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক যথা- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক, আন্তর্জাতিক, উপমহাদেশীয়, আইনগত, নারী, শিশু-কিশোর প্রভৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের প্রাপ্তি সত্ত্বেও ব্যাপক নয়। যুদ্ধের নির্দিষ্ট কোনো দিকের তথ্যের যথেষ্ট অপ্রতুলতা লক্ষ্য করা যায়। অধিকন্তু, এসব তথ্য সুসংবদ্ধ নয়। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত ইতিহাস, সমৃদ্ধ স্মৃতিচারণ, অবিনশ্বর কবিতা ও নাটক রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য ও শিল্পে প্রাজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ। তন্মধ্যে কিছু বই ব্যক্তিক অনুভূতি বহির্ভূত ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রণীত। তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ গ্রন্থে আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ অধিক। সে তুলনায় গবেষণামূলক বা তথ্যনিষ্ঠ গ্রন্থের সংখ্যা স্বল্প। মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ সংযোজন ‘মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র : অবিনাশী দলিল’ গ্রন্থ’টি। কোনো জাতির নিকট স্বীয় ইতিহাস গৌরবের বা পরাজয়ের, আনন্দের বা বেদনার হতে পারে। তদানীন্তন পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) তেইশ বছরের ইতিহাস কেবল বঞ্চনা, অন্যায়, শোষণ ও নিষ্ঠুর বর্বরতার। পাকিস্তান সরকারের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে দুই যুগের অধিক বাঙালি প্রতিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৫২-৭১ কালপর্বে এসব ঘটনা দৃশ্যকল্পে বা আলোকচিত্রে মূর্ত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘরসহ অসংখ্য বই ও পত্রপত্রিকায় বাঙালির সংগ্রামের এমন অসংখ্য আলোকচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব আলোকচিত্র ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশবিশেষ। মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম নির্ভরযোগ্য উপাদান ও উপাত্ত। এসব তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার তুলনায় আলোকচিত্রীদের ক্যামেরায় ধারণকৃত চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ অধিকতর প্রোজ্জ্বল। ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিনাশী দলিলরূপে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আলোকচিত্রকে অধিক সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ মনে করা হয়। অন্যদিকে, ক্যামেরার বস্তুনিষ্ঠতা হলো দৃষ্টিগোচরকৃত সমস্ত দৃশ্যকল্প ধারণের যান্ত্রিকীকরণ ও স্বয়ংক্রিয়ণের ফসল। ফলশ্রুতিতে, ইতিহাসকে নির্মোহ ও সত্যনিষ্ঠভাবে উপস্থাপনে আলোকচিত্র গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই আলোকচিত্রের মাধ্যমে মনের ভাব আদানপ্রদান সহজ হয়েছে। আলোকচিত্রের ভাষা সর্বত্রগামী। ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বয়ানে জনমানসে রয়েছে সহস্র দৃশ্যকল্প। দৃশ্যকল্পগুলোর বাস্তব রূপ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র বা ছবি। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববতীকালে পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট শোষণ, নির্যাতন, অসহযোগ, ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র, ১৯৭০-এর নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চ গণহত্যা, অগণিত বাঙালি নারীর সম্ভ্রমহানি, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ঐতিহাসিক ঘটনার দৃশ্যকল্প আলোকচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন বা প্রত্যক্ষকরণ সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রে রয়েছে নগ্ন অস্থিচর্মসার শিশু, দুর্ভিক্ষের হাহাকার ও গণহত্যার অনুপুঙ্খ চিত্রায়ণ। অধিকন্তু, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, সাহস, বীরত্ব ও সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগসহ বাঙালির বিজয়গাথার অসংখ্য স্মারক হচ্ছে আলোকচিত্র। আলোকচিত্রীর ক্যামেরার লেন্সে ধারণকৃত আলোকচিত্রে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর ও নির্মম অত্যাচারের ছবি দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে বিশ^বাসী স্তব্ধ হয়। বাংলার মুক্তিযুদ্ধকালীন আলোকচিত্র বিশ^বিবেককে দংশনের পাশাপশি বিশ্বমানবতাকে নীরবে দহন করেছে। মুক্তিসংগ্রামে সশস্ত্র যোদ্ধাদের সাথে অস্ত্রস্বরূপ ক্যামেরাকে সম্বল করে অকুতোভয় ও অসমসাহসী কয়েকজন আলোকচিত্রী যুদ্ধবিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন। ঘুরে বেড়ান বাংলার বিভিন্ন রণাঙ্গন। রণাঙ্গন ও ক্যান্টনমেন্টে লুকিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তার সহযোগী শক্তির অনুসরণ করেন। আলোকচিত্রীদের ধারণকৃত আলোকচিত্র হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এই জনযুদ্ধে যারা অস্ত্র হাতে পাকিস্তান হানাদার সৈন্য ও তাদের দেশীয় অনুচরদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তারা দেশ ও জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ-বিদেশের ফটো সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে উপহার দেবার জন্য। আমার বিশ্বাস, ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। একইসঙ্গে এই গ্রন্থের মাধ্যমে অবিনাশী দলিল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রের গুরুত্ব অনুধাবনে পাঠককে সহযোগিতা করবে।