স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে (একালের দশম) যখন পড়ি তখন একখানি নৌকাডুবি পাইয়া পড়িতে সুরু করি। কবিগুরু তাঁহার উপন্যাসে একটি বিচিত্র প্লট সৃষ্টির জন্য অনেকগুলি মানুষকে পদ্মার জলে ডুবাইয়া মারিলেন— এই অংশ পড়িয়া আমার মনটা খারাপ হইয়া গেল। আমার মনে হইল কবি কেন এতবড় নিষ্ঠুরতা দিয়া গ্রন্থ আরম্ভ করিলেন— জানিনা আরো কত নিষ্ঠুরতার পরিচয় পড়ে আছে । কাজেই সে যাত্রা আর আগানো চলিল না । ইহাই হইল আমার ষোলো বৎসর বয়সের বিচার দ্বিতীয়বার যখন নৌকাডুবি পড়িতে চেষ্টা করি তখন আমি কলেজে পড়ি। তখন Dickens, Mrs. Wood, Jane Austen, Victor Hugo ইত্যাদি নভেল পড়িয়াছি। তখন বইখানার অনেক দূর পর্যন্ত পড়িয়া ছিলাম । তখন মনে হইয়াছিল— নৌকাডুবির বিচিত্র প্লট সৃষ্টি করিবার জন্য কবিগুরু তাহার একটা বাস্তব রূপ দিতে গিয়া খুব সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছেন— কিন্তু অনেক ফাঁক থাকিয়া গিয়াছে। অথচ প্লটের সুবিধার জন্য তাহার রন্ধ্র ছিদ্র বুঝাইবার জন্য কী অসাধারণতারই না সহায়তা গ্রহণ করিয়াছেন । তাহা না হয় হইল । কিন্তু বিধাতা তাঁহার নিজের ছায়ামণ্ডপে বিশ্বপ্রকৃতিকে সাক্ষী রাখিয়া নিজের হাতে যে পরিনয় বাঁধনে রমেশ ও কমলাকে বাঁধিয়া দিলেন— তাহা হইল তুচ্ছ— আর অরক্ষণীয়ার সঙ্গে মন্ত্র পড়া আচারটাই হইল বড়? ইহা আমার ভালো লাগিল না । তাহা ছাড়া যতদূর পড়িলাম তাহাতে বাঙ্গালী জীবনের গার্হস্থ্য ও সামাজিক পরিবেশ পাইলাম না। পাত্র-পাত্রীর মুখে কথাগুলিও মার্জিত ভাষায় । বাঙ্গারীর পক্ষে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবনসংগ্রাম হইতে চরিত্রগুলিকে বিচ্যুত করা হইয়াছে। এই সকল কারণে গ্রন্থখানি শেষ করা হইল না। নষ্টনীড় ও চোখের বালি যেরূপ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শেষ করিয়াছিলাম— নৌকাডুবি সেইভাবে শেষ করা হইল না। এই হইলো আমার আঠারো বছর বয়সের বিচার। তারপর পাঁচ বছর পরে আবার নৌকাডুবি পড়িতে চেষ্টা করিলাম । তখন শরৎচন্দ্রের তিন চারখানি নভেল পড়িয়াছি। এইবার রুদ্ধশ্বাসে একদিনে নৌকাডুবি শেষ করিলাম । তখন মনে হইল নষ্টনীড়, চোখের বালি আর নৌকাডুবি এই তিনখানি বই পড়িয়াই শরৎচন্দ্র নিশ্চয় তাঁহার উপন্যাস রচনায় শিক্ষা ও দীক্ষা, প্রেরণা ও তাড়না লাভ করিয়াছেন। আমি যেন শরৎ সাহিত্য ভাগীরথীর উৎস মুখ আবিষ্কার করিলাম । এখন মনে হইল— আগে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য উপভোগ করার যোগ্যতাই আমার ছিলনা । এখন মনে হইল যে মানুষগুলিকে কবি জলে ডুবাইয়া মারিয়াছেন—সে গুলি সত্যই জীবন্ত মানুষ নয়— সেগুলি ছায়া মানুষ বা মায়া মানুষ—এইরূপ হাজার মায়া মানুষ নিহত হইলেও ক্ষোভের কারণ নাই— আমার এই ক্ষোভ ছিল অজ্ঞানেরই ফল! নৌকাডুবির পর বাঁচিয়া উঠিল রমেশ ও কমলা। ইহারাই মায়াদেহ ত্যাগ করিয়া আসল রক্তমাংসের দেহে ধীরে ধীরে জীবন্ত হইয়া উঠিল। ইহাদের জন্য সহৃদয় পাঠকের হৃদয়ে যে দরদের সঞ্চার হয় কবিগুরুর রচনার মধ্য দিয়া তাহাই রসরূপ ধরিয়াছে। রমেশ প্রাণহীনা কমলাকে জীবনদান করিল— সে ত নবজীবন প্রাপ্তা বালিকা-কিংবা খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন গল্পে খোকাবাবুর মায়ের কাছে রাইচরণের ফেলনা যেমন খোকাবাবু রমেশের কাছে পুনর্জীবিতা কমলা তেমনি বিবাহিতা পত্নী । কাজেই কমলাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করিলে দোষের কিছু হইত না— কিন্তু নৌকাডুবি উপন্যাসখানি হইত না। যে জন্য কবিগুরুর এত আয়োজন সবই ব্যর্থ হইয়া যাইত । আর গৌণ অভাবের কথা মনে হইয়াছিল গ্রন্থ শেষ করিয়া দেখিলাম- সেগুলির অনেকটা পূরণ হইয়াছে। আর পাত্রপাত্রীর মুখের জবানী যে সাধু ভাষায়- তাহা বঙ্কিমী রীতি। কবি ইচ্ছা করিলে পরবর্তী সংস্করণগুলিতে তাহা বদলাইতে পারিতেন, কিন্তু তৎকালীন রীতি রক্ষা করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিয়াছেন । 1 বিনা ক্লেশে রুদ্ধশ্বাসে পরে যে বইখানি পড়িয়া ফেলিলাম । তার কারণ উপন্যাসের ভাষার বাগ্বৈদগ্ধ্য আগে উপভোগ করিতাম না-এই বাগবৈদগ্ধ্যকেই কবিগুরুর কথা-সাহিত্যের প্রধান সম্পদ বলিয়া মনে করিবার মতো মতিবুদ্ধি পূর্ণযৌবনে জাগিয়াছিল। এই পুষ্পিত বাগবিলাসের আকর্ষিকা শক্তিই আমার চিত্তকে আগাইয়া লইয়া গেল । পাত্র-পাত্রীদের সকলের মুখে বাগ্বৈদগ্ধ্য যে সুসামঞ্জস্য নয়, পড়িতে পড়িতে সে কথা মনেই থাকে না। শরৎচন্দ্র এই অসামান্য বাগ্বৈদগ্ধ্য আত্মসাৎ করিতে পারেন নাই। গ্রন্থের আর একটি শুন ইহার ঔৎসুক্য ও কৌতূহল সৃষ্টি। এই ঔৎসুক্যই পাঠককে মাঝপথে থামিতে দেয় না ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।