তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) শরচন্দ্রের পরে বাংলা কথাসাহিত্যে পূর্ণশক্তিধর প্রতিভা। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম প্রভাবতী দেবী । গ্রামের হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯১৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । তারপর কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আই.এ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়াশোনা অসমান্ত রেখেই গ্রামে ফিরে যান । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কলেজে পড়াশোনার সময় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের অপরাধে ১৯২১ সালে কারা-নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯৩০ সালে ‘আইন অমান্য' আন্দোলনে যোগদান করে তিনি আবারও কারা বরণ করেন। কারাগারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যে পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন তা তার শিল্প-মানসকে পীড়িত করেছিল । তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি আর নয়, সাহিত্য বেসার পথেই তিনি দেশের সেবা করবেন ‘পদচিহ্ন' এবং ‘কালান্তর' উপন্যাস অনেকটা তাঁরই আত্মজীবনী । কালান্তরের নায়ক গৌরীকান্ত সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'দীর্ঘদিনে সে জীবনসাধনায় সার্থক হয়েছে—সে এখন প্রতিষ্ঠাবান সাহিত্যিক; তার সাহিত্য এই স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে মানুষের জীবনসংগীত ।’ গৌরীকান্ত সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উক্তি তাঁর নিজের সম্পর্কেও অনেকটা মিলে যায় । গ্রামের রক্ষণশীল সমাজের সঙ্গে তাঁর সংঘাত চলচিল বলে ১৯৩২ সালে তিনি স্ত্রী ও পুত্রকন্যাসহ কলকাতায় চলে আসেন এবং সাহিত্যকেই জীবিকা করবেন বলে স্থির করেন। কলকাতায় ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পর তিনি আবার লাভপুরে ফিরে যান। সেখানে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন।। ১৯৪৭ সালে তারাশঙ্কর মানসিক দিক থেকে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এর মূল কারণ তাঁর বার্ধক্যজর্জরিত ভগ্নস্বাস্থ্য । কলকাতায় যখন ফিরে এলেন তখন তাঁর দেহ এত দুর্বল যে, চলাফেরায়ও অনেক কষ্ট হতো। দেখা দিল পেসারের গোলমাল। স্বাস্থ্যহানি ছাড়াও তারাশঙ্করের সেদিনকার মানসিক অবসাদের আরো একটি নিগূঢ় কারণ আছে বলে অনুমান করা হয়। তা হলো তাঁর মনে নাস্তিক্যবাদ ও আস্তিক্যবাদের দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বিশেষ করে কম্যুনিস্টদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির পর তাঁর অধ্যাত্মবিশ্বাস বিচলিত হয়ে পড়েছিল। তারাশঙ্করের সাহিত্যেও এর প্রভাব লক্ষ করা যায়।। তারাশঙ্কর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাসে সামন্ত্রতন্ত্রের সঙ্গে ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বের চিত্র পাওয়া যায়, সেই দ্বন্দ্বে জমিদার শ্রেণির পরাভব ও শিল্পপতি আর ব্যবসায়ী শ্রেণির বিজয় হয়েছে। যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে কৃষিসভ্যতার বিরোধও তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়, সেই বিরোধে গ্রামীণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভাঙন ও শিল্পকেন্দ্রিক শহুরে অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে । এভাবে গ্রামীন জীবনের সামাজিক বিপর্যয় এবং তারই মধ্যে গোটা মানুষের অভ্যুদয় নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে ।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর শৈশব কাটে এই বীরভূম জেলারই লাভপুর গ্রামে। ধর্মপরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ বাবা-মায়ের কাছে তিনিও একই সততা ও আদর্শের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করতে পারেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ করতে হয় তাঁর। মুক্তি পাওয়ার পর সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। তাঁর অনন্য প্রতিভায় জন্ম নিয়েছে একেকটি অসাধারণ পাঠকনন্দিত সাহিত্যকর্ম। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সম্পদ। তাঁর লেখা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জীবনকে এককভাবে উপস্থাপন করে না, ফুটিয়ে তোলে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সব বৈশিষ্ট্যকে। সাহিত্য সৃষ্টি করতে তিনি বাদ রাখেননি কোনো শাখা। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২)’, ‘পাষাণপুরী (১৯৩৩)’, ’ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯)’, ’কালিন্দী (১৯৪০)’, ’কবি (১৯৪৪)’, ’হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১)’, ‘কালরাত্রি (১৯৭০)’ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের উপন্যাস সমগ্র সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৬৫টি। এর মধ্যে ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মাঝে তিনি বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী ও সাহিত্য সম্মেলন এর নেতৃত্ব দান ও সভাপতিত্ব করেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তিনি আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কবিতা সমগ্র হল ‘ত্রিপত্র (১৯২৬)। এছাড়াও সাহিত্য রচনা করেছেন ছোটগল্প, নাটক, প্রহসন ও প্রবন্ধ আকারেও। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প সংকলন হলো ‘ছলনাময়ী (১৯৩৭)’, ‘রসকলি (১৯৩৯)’, ‘হারানো সুর (১৯৪৫)’, ‘কালান্তর (১৯৫৬), ‘মিছিল (১৯৬৯)’, ‘উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত অনেক উপন্যাস পেয়েছে চলচ্চিত্র রূপ, এদের মাঝে আছে ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘শরতস্মৃতি পুরস্কার (১৯৪৭)’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৫৬)’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫)’, ‘পদ্মশ্রী (১৯৬২)’, ‘পদ্মভূষণ (১৯৬৮)’ ইত্যাদি পুরস্কার ও উপাধি লাভ করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর বই সমূহ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। পাঠকনন্দিত এই বাঙালি কথাসাহিত্যিক ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন।