মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন লেখকের জীবনদর্শন শৈল্পিক রূপায়নের মাধ্যমে গদ্যসাহিত্যে বিকশিথ হলে তা উপন্যাসের সংজ্ঞা ধারণ করে। লেখকের ভাবনা এমন ভাবে এখানটায় উপস্থাপিত হয়, যা মনে হবে সম্পূর্ণ বাস্তব। এতে ফুটে ওঠে সমগ্র জীবনের প্রতিচ্ছবি । তাইতো সংগত কারণে এর পটভূমি হয় বিস্তৃত । সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনাবিন্যাস আকর্ষণীয় গল্পরস, বাস্তবতার নিরিখে চরিত্র সৃষ্টি, মনোমুগ্ধকর বর্ণনাভঙ্গি ও সাবলীল সংলাপ উপন্যাসের প্রধান প্রধান বৈশিষ্টসমূহ। উপন্যাসের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে এর কাহিনীর বর্ণনাই উল্লেখযোগ্য হিসেবে দেখা দেয়। উপন্যাসে থাকে মানুষের জীবনের বর্ণনা, ও রহস্যময় সৃষ্টির বর্ণনা। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির অফুরান রহস্যের মধ্যেই উপন্যাসের অস্তিত্ব নিহিত । উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়। বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক অবস্থায় ব্যঙ্গচিত্র মূলক সাহিত্যে এর আভাস অনুভূত হয়। বাস্তব জীবনের খণ্ড খন্ড চিত্র কাহিনীর ঐক্যসূত্রে গ্রথিক হয়েই উপন্যাসের অঙ্কুরোদগমন হয়েছিল বাংলা গদ্যসাহিত্যের উষালগ্নে। কালগত দিক থেকে উপন্যাস হিসেবে প্রথম যে গ্রন্থটির দাবি সেটি হচ্ছে খ্রিস্টান বিদেশিনী হ্যানা ক্যাথারিন ম্যালেন্স (১৮২৬-৬১) 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ' (১৮৫২) গ্রন্থের । খ্রিস্ট ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার ছিল এ গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য। এর পরে আসে প্যারীচাদ মিত্রের 'আলালের ঘরে দুলাল' (১৮৫৮) গ্রন্থটি। এ গ্রন্থটিতে বর্ণীত হয় তৎকালীন কলকাতার শিক্ষাদীক্ষা, আচার-অনুষ্ঠানের ব্যঙ্গত্মক চিত্র। ডা. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, গ্রন্থটি ছিল তৎকালীন সময়ের উপন্যাস সৃষ্টির একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। তার মতে 'আলালের ঘরের দুলালই বোধ হয় বঙ্গভাষার সর্বপ্রথম সম্পূর্ণাবয়ব ও সর্বাঙ্গ সুন্দর উপন্যাস।' বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে প্যারচাঁদ মিত্রের পরে আবির্ভূত হন কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা' (১৮৬২) গ্রন্থটি রচনার মধ্য দিয়ে। এ গ্রন্থটিও সে আমলের কলকাতার কতকগুলো চিত্র ব্যঙ্গরস সহযোগে রচিত হয়। এর পর আবির্ভাব ভুদেব মুখ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর 'ঐতিহাসিক উপন্যাস' (১৮৫৭) গ্রন্থে 'সফল স্বপ্ন' ও ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়' শিরোনামে দুটি আখ্যান স্থান পায়। কন্টারের লেখা ঐতিহাসিক গালগল্প Romance of History - India গ্রন্থের যে কোনো কাহিনীকে অবলম্বন করেই এ গ্রন্থ দুটি উপন্যাসের আদলে রচিত হয়েছিল। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পরেই আগমন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪)। তার প্রথম উপন্যাস 'দুর্গেশনন্দিনী' প্রকাশিত হয় (১৮৬৫) খ্রিস্টাব্দে। বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষার কালাতিক্রমে পর এটিই বাংলা সাহিত্যে সার্থক উপন্যাসের ধারার প্রথম উপন্যাস।
Mohammad Nazibar Rahman- (১৮৬০১৯২৩) পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার (এখন সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের) অন্তর্গত চরবেলতৈল গ্রামে আনুমানিক ১৮৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। নর্মাল স্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ-সম্পাদিত মাসিক ইসলাম-প্রচারক পত্রিকায় ১৯০১ সালের ‘পূর্ব¦স্মৃতিÑকুতবুদ্দীন আয়বক’ নামে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বঙ্গভঙ্গের কালে তিনি লেখেন বিলাতী বর্জন-রহস্য (১৩১১)Ñযে কোনো কারণে হোক, সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে। পরিণত বয়সের রচনা আনোয়ারা (১৯১৪) মোহাম্মদ নজিবর রহমানের প্রথম উপন্যাস। একে সামাজিক ও পারিবারিক উপন্যাস বলা হয়েছে হয়তো এই কারণে যে, এতে পারিবারজীবনের একটা আদর্শ খাড়া করা হয়েছে সেইসঙ্গে সমাজ সম্পর্কেও লেখকের অঙ্কিত চিত্রের সঙ্গে তাঁর একটা অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে। সতী নারীর আদর্শ জীবন কেমন হওয়া উচিৎ, এতে নজিবর রহমান তাই বলতে চেয়েছেন। সেইসঙ্গে তখনকার বাস্তব অবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রেমের উন্মেষ ও তার সার্থকতা ও শিক্ষার অভাব, মিথ্যা কুৎসারটনা, দলাদলি ও চক্রান্ত, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ব্যক্তির আন্তম্ভরিতা প্রভৃতি-তিনি বেশ নৈপুণ্যের সঙ্গে অঙ্কণ করেছেন। মনে হয়, বংশের আভিজাত্যে লেখকের কিছুটা আস্থা ছিল। আর উপদেশদানের প্রবৃত্তি ছিল অত্যন্ত বেশি। এইজন্যে মূল চরিত্র আনোয়ারা অনেকখানি নিষ্প্রাণ হয়েছে, তুলনায় পার্শ্বচরিত্রেরা সজীব। তবে সমগ্র বই থেকে লেখকের যে-অভিপ্রায় বেরিয়ে এসেছে, তা এই যে, বাঙালি মুসলমান যেন শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হয়, পরিবারে যেন ইসলামের নির্দেশসম্মত জীবনযাপন-প্রণালি অনুসৃত হয় এবং চাকরির চেয়ে যেন ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা অদিকতর মনোনিবেশ করে। আনোয়ারার একটা সমালোচনা লিখেছিলেন গোলাম মোস্তফা বঙ্গীয় মুলমান-সাহিত্য-পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩২৬)। তা থেকে সমকালীন সাহিত্যরুচি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। উপন্যাসে আনোয়ারা যখন অজু করতে যায় তখন আনোয়ারার সঙ্গে অদূরে ভেড়ানো নৌকোয় অবস্থানকারী নুরুল ইসলামের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সমালোচক বলেছেন, ‘এরূপ অনাবৃত স্থানে বয়স্কা মুসলমান বালিকা অজু করিতে সঙ্কোচ বোধ করে। যদি না করে, তবে সে বেহায়া। তারপর অন্য এক স্থানেও লেখক এই “আশরাফী” রক্ষা করিতে পারেন নাই। ... সেই যে চারি চক্ষুর সম্মিলন,Ñতার সঙ্গে সঙ্গেই then and there আনোয়ারার “জ্বর ও শিরঃপীড়ায়” আক্রান্ত হইবার কথা নিতান্তই হালকা এবং আটশূন্য।’ তবে সমালোচকের আপত্তির মূল কারণ হলো : ‘ধর্ম এবং সামাজের দিক দিয়া দেখিতে গেলে ওরূপ পূর্ব¦বিবাহ-প্রেম আদৌ সমর্থনযোগ্য নহে। উহা পাশ্চাত্য রীতি।’ তারপরও গোলাম মোস্তফা বলেছেন যে উপন্যাসটির ‘দুই এক স্থান Romantic এবং অবাস্তবতা দোষদুষ্ট হইলেও প্লট সম্বন্ধে অনেক বিশেষত্ব ও মৌলিকত্ব আছে। আনোয়ারার চরিত্র মুলসমানী কায়দায় সুন্দররূপে সৃষ্টি করা হইয়াছে।’ সমালোচক একথাও স্বীকার করেছেন যে, ‘আনোয়ারা লেখকের রচনাপদ্ধতি খুব সুন্দর। ভাষার উপর তাঁহার বেশ আধিপত্য আছে। বর্ণনা কৌশলও সুন্দর এবং সরল।’ একান্ত ধর্মীয় মাপকাঠি দিয়ে সাহিত্যবিচারের যে-প্রবণতা, তার থেকে খানিকটা সরে এসে ভাষা-রচনাশৈলী-চরিত্রাঙ্কনের আলোচনা একধরনের সাহিত্যিক প্রাপ্তবয়স্কতার পরিচয় দেয়। আনোয়ারা বাঙালি মুসলমান সমাজে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। শিক্ষিত পরিবারমাত্রেই একসময়ে বইটির স্থান ছিল। লেখকের পক্ষে তা কম শ্লাঘার বিষয় নয়। মনে হয়, বাঙালি মুসলমান পাঠককে উপন্যাসের অনুকূলে আনতে বইটি সাহায্য করেছিল। তবে নজিবর রহমান নিজেই শেষরক্ষা করেননি। বঙ্গীয় মুলমান-সাহিত্য-পত্রিকায় (কার্তিক ১৩২৮) এম. আনসার আলী লিখেছিলেন: ‘“আনোয়ারাঃ মুসলমান সমাজে বেশ আদর লাভ করিয়াছিল। কিন্তু “প্রেমের সমাধি”তে এই বৃদ্ধ গ্রন্থকারের যে এমন জীবন্ত সমাধি হইবে, তাহা কে জানিত!’ প্রেমের সমাধি রচিত হয়েছিল কিছুটা আনোয়ারার পরিশিষ্ট হিসেবে। তবে তাতে এমনসব অলৌকিক বিষয় লেখক অবতারণা করেছিলেন যে, উপন্যাসের সীমার মধ্যে আর তাকে ধরে রাখা যায়নি। আনোয়ারা নজিবর রহমানের সেরা লেখা তো বটেই, বিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্বের একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়