শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীকান্ত উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তাঁর সময়কে সার্থকভাবে চিত্রিত করেছেন। তাঁর লেখায় সে সময়ের সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, বঞ্চনা ও জাতিগত ভেদাভেদ চিত্রিত হয়েছে। শ্রীকান্ত সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থার নিখুঁত বর্ণনা এত বছর পরও আমাদের মনে দাগ কাটে। তৎকালীন হিন্দু সমাজের সনাতন ধ্যান ধারণার বর্ণনা আমরা এই উপন্যাসের মাধ্যমে পাই। শরৎচন্দ্র এই অন্ধকার মানসিকতার বিরুদ্ধে বারবার অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। আমরা শ্রীকান্ত উপন্যাসে সাধুরীতি ও চলতিরীতির সংমিশ্রণ দেখতে পাই। কিন্তু শরৎচন্দ্র উভয় রীতিকে এতটা নিপুণভাবে প্রয়োগ করেছেন যে তা গুরুচন্ডালি না হয়ে নান্দনিক হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসে চরিত্রগুলোর বিন্যাস অত্যন্ত নিখুঁত। চরিত্রসমূহ একের পর এক চিত্রিত হয়েছে নানা ঘটনার মাধ্যমে তাদের জীবনের দুঃখ কষ্ট বিবৃত করে। এসকল চরিত্রের সমন্বয়ে শরৎচন্দ্র শ্রীকান্তকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে গেছেন। অপূর্ব ভাষাশৈলী এবং অসাধারণ বর্ণনা নিতান্ত উপেক্ষিত স্থানকেও করে তুলেছে সৌন্দর্য্য । যেন তা এ-সকল স্থানের মধ্যে বিরাজমান ছিল। কিন্তু তা কখনও বাহুল্যে ভারাক্রান্ত নয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মহাশ্মশানের বর্ণনা। অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যের বর্ণনাও অত্যন্ত প্রাণবন্ত, যা পাঠককে ঐ স্থানে এবং ঐ সময়ে নিয়ে যায়। লেখক বারবারই সমাজের অমানবিক দিকসমূহকে চিহ্নিত করেছেন। এই সকল অন্ধকারচ্ছন্ন কুসংস্কার আমাদের সমাজকে কতটুকু এগিয়ে নিয়েছে তা বলা না গেলেও বারবার যে পিছনে টেনে ধরেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ কিংবা রাজলক্ষীর মতো চরিত্রদের মাধ্যমে শরৎচন্দ্র এ-সকল দিক বারবার আলোকপাত করেছেন। শ্রীকান্ত উপন্যাসে ঘটনাসমূহ অত্যন্ত গতিশীল। যদিও ঘটনাবলি মাঝেমধ্যেই শ্রীকান্তের কৈশোর এবং যৌবনের মাঝে ঘোরাফেরা করে, তথাপি শরৎচন্দ্রের অসাধারণ দক্ষতা, ঘটনাসমূহকে বেঁধে রাখে একটি নির্দিষ্ট গন্ডীতে। তিনি যেকোনো বিষয়ের বর্ণনা করেন বিস্তৃতভাবে। ফলে পাঠক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসটির সঙ্গে একাত্মভাবে মিশে থাকেন। উপন্যাসটির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে মনে হয় ‘শ্রীকান্ত’ শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।