নিহাররঞ্জনের বইয়ের ভূমিকা লিখতে বসে ঘুরেফিরে একই কথা আসে । তার লেখার ক্লান্তি ছিল না । কিশোর বয়স থেকেই লেখা আরম্ভ করেছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ৭৬ বছর বয়স পর্যন্ত উনি লিখেছেন। লেখা শুরু করার পর থেকে একদিনের জন্যও কখনও লেখা বন্ধ করেননি । হাজার কাজের মধ্যেও ভোরবেলা ও দুপুরবেলা নিহাররঞ্জন তার লেখার টেবিলে বসতেন। কখনো তাকে একনিষ্ঠতার অভাব অনুভব করেনি। নিহাররঞ্জন যা করবেন বলে ভেবেছেন সেটা না করা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। নিহাররঞ্জের বহু বই উপন্যাস ও গল্পের আকারে লিখে গেছেন। তার মধ্যে অনেক বই প্রকাশ হয়েছিল । নিহাররঞ্জন গুপ্ত তার লেখনি এমনি ভাবে লিখতেন যে, মনে হয় কেউ আমার কাছে গল্প শুনাচ্ছেন। তার রচনাগুলো পড়ি তখন মনে হয় তাঁর লেখার চরিত্রগুলো আমাদের সামনে ঘুরাফেরা করছে। এই কথাগুলো শুধু আমার নয় পাঠকদের কাছে শুনেছি। এখনও যারা নিহাররঞ্জনের রচনা পড়তে ভালবাসেন । তারাও আমার সাথে একই কথা বলবেন । নিহাররঞ্জন আজ আমাদের মাঝে নেই তারপরও তাঁর রচনাগুলো মনে হয় আমার মত পাঠক/পাঠিকার মন থেকে মুছে যাইনি। সব রকমের লেখাই অতি সুন্দর করে লিখেছেন। শিশু ও বৃদ্ধরা কেউই এ রস থেকে বঞ্চিত হয়নি। বর্তমান যুগের পাঠকরা যাতে এ হতে বঞ্চিত না হয় তাই এই প্রচেষ্টা এবং আশা করি সফল হবে ও ভবিষ্যতে ও অব্যাহত থাকবে। রচনাগুলো শিল্পলক্ষণ বিচারে যেমন উৎকৃষ্ট, তেমনি বাঙালির গ্রামীণ ও নাগরিক চিত্র হিসেবেও তার মূল্য অসাধারণ। কিন্তু তাই বলে তিনি রচনাগুলোকে শুধু বাঙালি জীবনের স্থানকাল ঘেরা গণ্ডির মধ্যে সংকীর্ণ করে রাখেন নি। বাঙালি জীবনের আঁধারে এর মধ্যে চিরকালের মানুষের সুখ-দুঃখ স্থান পেয়েছে, তাই বিদেশীরাও তাঁর রচনার মধ্যে নির্মল আনন্দ খুঁজে পান। বিশেষ বিশেষ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে শিল্প সৃষ্টি হতেই পারে না, একথা কড়াকড়ি করে মানলে অনেক শিল্পীকেই লেখা থেকে বিদায় নিতে হবে। সর্বশেষে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি । জাহিদা মেহেরুননিসা সহকারী অধ্যাপক (বাংলা বিভাগ) ইডেন মহিলা কলেজ
বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটি রায় এর স্রষ্টা এবং জনপ্রিয় রহস্য কাহিনী লেখক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, একইসাথে ছিলেন একজন চিকিৎসকও। একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে দুই বাংলাতেই লাভ করেছেন বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা। ওপার বাংলায় বেড়ে ওঠা ও জীবন কাটালেও তিনি জন্মেছিলেন এপার বাংলায়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় ১৯১১ সালের ৬ জুন বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয় পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রখ্যাত কাহিনীকার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করতে হয়েছে । শেষ পর্যন্ত কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন ও চর্মরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ডাক্তার হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন দেশের রণাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে সেবাদানের পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যার ছাপ পরবর্তীতে পড়েছে নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমূহতে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই লেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই এবং সেই সূত্রে তিনি অনেক কম বয়সেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাজকুমার' রচনা করেন। তবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস এর মধ্যে তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে তাঁর লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস সমূহ, যা রচনা করার আগ্রহ থেকে তিনি ব্রিটেনে অবস্থানকালে সাক্ষাৎ করেন আরেক বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনী রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির সাথে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এর মধ্যে প্রথমটি হলো 'কালোভ্রমর', যেখানে তিনি সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সেরা সৃষ্টি গোয়েন্দা কিরীটি রায়ের সঙ্গে। এছাড়াও নীহাররঞ্জন গুপ্তের রচনাবলী এর মধ্যে 'মৃত্যুবাণ', 'কালনাগ', 'উল্কা', 'হাসপাতাল', অপারেশন', 'কিরীটি অমনিবাস' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই এর সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। আর নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমগ্র এর মধ্যে প্রায় ৪৫টি নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এছাড়াও তিনি 'সবুজ সাহিত্য' নামে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ৭৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।