সুনীল নামে যে ছেলেটি গান করছিল, সে সেইরকম এক জন দুর্ভাগা। খুনের মামলার আসামি সে। দশ বছরের জেল। খুন সে করেছিল, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। অথচ সে গানও গাইতে পারে। বাইরের জীবনে, সে একজন গায়ক হতে চেয়েছিল। কিন্তু জীবনে হতে চাওয়া আর করতে চাওয়ার সঙ্গে, হয়ে যাওয়া আর করে ফেলার যেন একটা চির-দ্বন্দ্ব আছে। সে রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছিল, খুন করেছিল তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বীকে। এ যেন অনেকটা, পৃথিবীতে এত সংগীত সৃষ্টি হল, এত কাব্য, এত শিল্প-সাহিত্য, সেই মহাভারতের সময় থেকে, গ্রিক ও রােমান সংস্কৃতির সময় থেকে, রবীন্দ্রনাথ টলস্টয় পর্যন্ত, তারও পরে অনেক, তবু বিশ্বযুদ্ধ হয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, রক্ত নিয়ে মানুষ হােলি খেলে চলে, আরও খেলবে। কত দিন ধরে, কে জানে! ধর্ম হয়তাে অনেকখানি বিগত, তাই ধর্মের নামে তত নয়, রাজনীতির নামেই আজ রক্তপাত বেশি। বেদ উপনিষদ যদি কাব্য হয়, তা হলেও, আজ পর্যন্ত সে সব কিছুই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার উর্ধ্বে উঠতে পারেনি, জয় করতে পারেনি। একদিন হয়তাে পারবে, তাই বাতি হাতে করে মানুষ যাত্রা করেছে বহুকাল। বাতিটা বড় নিভু নিভু। তেলের অভাব পড়েনি। অন্ধকারের গাঢ়তা এত বেশি, তার ঝড়ের বেগ এত প্রবল, বাতিটা কেবলি মূৰ্ছা যায়। রক্তাক্ত হাতগুলাে কেবল, বাতি নেভাতে নেভাতে বলে, গর্জায়, বাতি নেভাও, বাতি নেভাও, পুট আউট দ্য লাইট, পুট আউট দ্য লাইট। এতে করে মনে হয়, সুনীলের গান গলায় ছিল, প্রাণে নয়। প্রাণে যখন গান এল, তখন সে জেলখানায়। তখন সে অন্ধকারের অতলে। হয়তাে,এ-ই মুক্তির স্বরূপ। সে যে গায়ক হতে চেয়েছিল, এবং আরও যা কিছু হতে চেয়েছিল, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম—প্রেমিকা। সেখানে হার তাে জীবনেরই হার। আর সব কিছুই পরে পরে, দূরে দূরে। তাই হাত ভরে রক্ত মাখা। প্রেমিকাকেও পায়নি। হয়তাে এখন তার কথা ওর মনে পড়ে, সেই প্রেমিকার কথা, যাকে ও আর কোনও দিনই পাবে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি, যেখানে শুধু ঘুম নয়, ক্ষুধাও ভুলেছে, চোখের তারায় খাঁচায় আবদ্ধ নেকড়ের চকিত তীক্ষ্ণতা। অন্ধকারের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দৃষ্টি চালনা। প্রায় রুদ্ধশ্বাস অস্থিরতায় শরীরের প্রতিটি পেশি ও হৃৎপিণ্ড শক্ত,আড়ষ্ট। দোতলায় ওঠবার সিড়ির কাছে, অন্ধকারে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দু জন বসে আছে। তারা দুজনে, দুজনের হাত শক্ত করে ধরে আছে। সুনীল গান গেয়ে ওঠার আগে।
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।