পূর্ব-আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া। এর পূব দিক জুড়ে ভারত মহাসাগর, আর সীমানার সাথে রয়েছে আরো কিছু দেশ ও দ্বীপ। নানান জাতির মিলমিশে গড়ে ওঠা এই ভূখণ্ডের প্রধান ভাষা সোয়াহিলি হলেও প্রচলিত রয়েছে শ’খানেকের বেশি ভাষা। পারস্য উপসাগর এবং ভারতের বণিকেরা পূর্ব আফ্রিকার উপক‚লে বাণিজ্য করে এসেছে বহুযুগ ধরে। দাস কেনাবেচাও হতো সেখানে। সোয়াহিলি উপক‚লের এই অধিবাসীদের একটি বড় অংশই ছিল মুসলিম। আরো পরে এই জায়গাটা আরবদের ব্যবসার ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও পরের কয়েক বছর ক্ষমতা থাকে মূলত উপনিবেশিক প্রতিনিধিদের হাতেই। ১৯৬৪ সালে তাঙ্গানিকা (তান) ও জাঞ্জিবার (জান) নামের দুটি দেশ মিলে গঠিত হয় নতুন দেশ তানজানিয়া। প্রায় দশ লাখ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশের রাজধানী হয় দার-এস-সালাম। তানজানিয়ার উত্তর-পূর্বে ঘন বন আর পর্বতমালায় ঘেরা কিলিমানজারো। ক্ষুধা, দারিদ্র আর অপুষ্টিতে জর্জরিত আজকের তানজানিয়ার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর (তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া)।
১৯৪৮ সালে এই তানজানিয়ারই জানজিবার দ্বীপে জন্ম নোবেলজয়ী লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহর। ষাটের দশকে সেখানকার বিপ্লব ও দাঙ্গার ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যে স্থায়ী হন তিনি। এই অভিবাসন পরে তাঁর শিক্ষা, গবেষণা এবং লেখালেখিতে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে, ফলে উপনিবেশিকতা ও শরণার্থী সংকটের মতো বিষয়গুলি উঠে আসে আলাদা মাত্রায়। সেই ধারাবাহিকতায় উপনিবেশবাদের প্রভাব এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশের মধ্যে উপসাগরীয় শরণার্থীদের পরিণতির অবিচল ও অনুভ‚তিশীল অন্তর্ভেদ-এর জন্য ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন আবদুলরাজাক গুরনাহ। ২০১৭ সালে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসরের পর এখন সেখানকার ইংরেজি এবং উত্তর-উপনিবেশবাদ সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক এই নোবেলজয়ী। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা দশ যার প্রথমটি মেমোরি অব ডিপারচার প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। এছাড়া তাঁর রয়েছে ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ সংকলন। দারিদ্র, রাজনীতি, শোষণ, দাসপ্রথা, বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় বিভাজনের প্রেক্ষাপটে উপনিবেশের আগের এবং পরের পূর্ব-আফ্রিকার মানুষের জীবন ও সংগ্রামের গল্প তাঁর লেখায় উঠে এসেছে গতিময় অনুপুঙ্খ বর্ণনায় (সূত্র : ইন্টারনেট)।
আবদুলরাজাক গুরনাহর রচনার সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি তাঁর প্রথম উপন্যাস মেমোরি অব ডিপারচার-এর মাধ্যমে। এই অনুবাদ মূলত সেই অভিজ্ঞতা সবার সাথে ভাগ করে নেয়ার প্রয়াস মাত্র। বহুমাত্রিক বর্ণনায় ঋদ্ধ আবদুলরাজাক গুরনাহর লেখাগুলো পূর্ব-আফ্রিকার সমাজ ও জীবনের এক অনন্য দর্পণ। একই সাথে আফ্রিকার রাজনৈতিক ইতিহাস আর অর্থনৈতিক চিত্রের পাশাপাশি এই উপন্যাসে উঠে এসেছে এক তরুণ-তরুণীর ভালবাসার আখ্যান। জীবনের গভীর বোধকে কখনও ছুঁয়ে গেছে পরাবাস্তবতা।
প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্যে দিয়ে দ্বি-জাতি তত্ত¡ নির্ভর সাতচল্লিশের দেশভাগ, তার পরের একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, ভাষা ও সংস্কৃতিনির্ভর রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার প্রত্যয় এবং পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের লিটারারি ডিসকোর্সে উপনিবেশ, দেশত্যাগ, রিফিউজি, বাস্তুচ্যুতি, শরণার্থী সংকটের মতো বিষয়গুলো বড় জায়গা করে আছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এখানকার উত্তর-উপনিবেশিক শোষণ, বঞ্চনা আর দারিদ্র্যের সাথে লড়াইয়ের দীর্ঘ, অনিশ্চিত যাত্রার গল্প। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে ডায়াসপোরা যেমন প্রাসঙ্গিক তেমনি সমকালীন। এই প্রেক্ষাপটে বিশেষত ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল জয়ের ধারাবাহিকতায় আবদুলরাজাক গুরনাহর রচনার প্রতি বাংলাভাষাভাষী পাঠকের আগ্রহ তৈরি হয়। বইটি পাঠককে উত্তর উপনিবেশিক পূর্ব আফ্রিকার মানুষের জীবন ও সমাজের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।
মূলত ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও বহু সোয়াহিলি ও আরবি শব্দের সমাবেশ ঘটেছে এই বইয়ের ন্যারেটিভকে কেন্দ্র করে। পরিভাষাগুলো অপরিবর্তিত রেখে মূল লেখকের বর্ণনায় সেই সময় ও সমাজের একটি প্রায় অবিকল চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছি। একই সাথে পাদটীকার মাধ্যমে কিছু পরিভাষা নিকটবর্তী বাংলায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিভিন্ন সূত্র থেকে, যার মধ্যে ইন্টারনেট অন্যতম।