জীবনের রূপ দর্শন করতে বেরিয়েছিলেন তিনি। শুধু বাইরের দেখা নয়, একেবারে ভেতর থেকে দেখা। কত ধরনের দেখা, কত রকমারি দৃষ্টিপাত। তাঁর নিজের ভাষায়: ‘দিন রাত্তির সতর্ক চোখে ঘুরেছি। যা দেখেছি, যেটা ভাল লেগেছে, তুলে ধরেছি।...’ জীবনের রূপ দেখতে দেখতে তিনি রূপদর্শী। কখনও বা নক্শা, কখনও বা সংবাদভাষ্য, কখনও বা ঝাঁকিদর্শন, আবার কখনও কখনও তাঁর সোচ্চার চিন্তায় ত্রিকালদর্শন। রম্যরচনার অঙ্গনে পা রেখেছিলেন নক্শার ঝাঁপি হাতে নিয়ে। রেখার আঁকিবুকি, অথচ অসামান্য শিল্পকাজ। ভেতর থেকে দেখার তাগিদ নক্শার পরতে পরতে। একসময় নক্শাকার থেকে ভাষ্যকারে তাঁর প্রতিসরণ ঘটে। রোজকার ঘটনা বুঝে বেছে তৈরি হয় সংবাদ, আবার সেই সংবাদকে দাগানো হয় ভাষ্যে। নক্শা কিংবা নক্শাধর্মী রচনাগুলিতে তিনি রঙ্গব্যঙ্গের অনাবিল রূপকার। সংবাদভাষ্যে রূপদর্শী আদ্যন্ত বিশ্বাস ও সচেতনতায় ভরপুর এক আত্মবিশ্বাসী, নিঃশঙ্ক মানুষ। যা কিছু ধ্রুব ও শুভ তাকে ভাষ্যের মাধ্যমে সবাইকে জানানো তাঁর দায়িত্ব। এখানে তাঁর ভূমিকা কেবল দর্শকের নয়, প্রদর্শকেরও। রূপদর্শী ছদ্মনামের আড়ালে গৌরকিশোর ঘোষ ‘জীবনের যে বহুতর রঙের ছবি’ পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, দুই খণ্ডে সেইসব অন্তর্ভেদী এবং বক্ররসে জারিত রচনাকে সংবদ্ধ করা হয়েছে। এই খণ্ডে আছে রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য, সোচ্চার চিন্তা, মুখোমুখি, ঝাঁকিদর্শন ও অলমিতি বিস্তরেণ।
গৌরকিশোর ঘোষ (২২ জুন, ১৯২৩ - ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০) একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তিনি রূপদর্শী ছদ্মনামে গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের যশোর জেলায় হাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক পড়াশোনা করেন শ্রীহট্ট জেলার এক চা-বাগানে। স্কুলের পাঠ নদিয়া জেলার নবদ্বীপে। ১৯৪৫ সালে আইএস-সি পাশ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত গৌরকিশোর ক্রমাগত পেশা বদলে গেছেন। প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, খালাসি, রেস্তরাঁয় বয়, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, ইস্কুল মাস্টার থেকে ভ্রাম্যমান নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার ইত্যাদি অসংখ্য কাজ করেছেন সাংবাদিক জীবনে প্রবেশের আগে পর্যন্ত। স্বাধীনচেতা সাংবাদিক গৌরকিশোর ১৯৭৫ সালের 'মিসা' (MISA) অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জন-নিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার হন। প্রেসিডেন্সি জেলে তাকে বন্দী রাখা হয়। সাংবাদিকদের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বহু নির্যাতন সহ্য করেও নিরন্তর সংগ্রামের ব্রতী ছিলেন। মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনার জন্যে বুদ্ধিজীবী মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। তার সাহিত্য বাঙলার বিদগ্ধ পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করতেন তিনি। দেশ পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আশির দশকে আজকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দেশ-মাটি-মানুষ ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড 'প্রেম নেই' গ্রামীন মুসলিম জীবন নিয়ে সুবিশাল রচনা। দেশ পত্রিকায় এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বের হয়। এছাড়া সাগিনা মাহাতো, জল পড়ে পাতা নড়ে, আনাকে বলতে দাও, আমরা যেখানে, লোকটা, রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য ইত্যাদি তার অন্যান্য গ্রন্থ। সাগিনা মাহাতো, তপন সিংহর পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। গৌরকিশোর সৃষ্ট মজলিশি চরিত্রের নাম ব্রজদা। সাংবাদিকতার জন্যে তিনি ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার 'কো জয় উক' স্মৃতি পুরষ্কার এবং ১৯৮১ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই বছর মহারাষ্ট্র সরকারের পুরষ্কার, ১৯৯৩ সালে হরদয়াল হারমোনি পুরষ্কার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরষ্কার পান। তিনি ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার ও ১৯৮২ তে বঙ্কিম পুরষ্কার পান। কলকাতা মেট্রো রেলের নতুন প্রস্তাবিত চিংড়িহাটা স্টেশনটি গৌরকিশোর ঘোষের স্মৃতিতে রাখা হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে মারা যান গৌরকিশোর ঘোষ।