"রবীন্দ্র-প্রসঙ্গঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ৩য় খণ্ড" বইয়ের প্ল্যাপের লেখা:
শ্রী নিকেতনের একনিষ্ঠ সেবক লেনার্ড এলমহার্স্ট ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহচর। কবিকে তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ভেবেছিলেন এই পরিচয়ের সুযােগে তিনি কবি-জীবনী রচনা করবেন। কিন্তু লিখতে বসে উপলব্ধি করলেন কবির অজস্র ভাবধারা এবং অসাধারণ কর্মবৈচিত্র্য একটি জীবনীগ্রন্থের মধ্যে রূপ দেওয়া সম্ভব নয়। এই উপলব্ধির প্রমাণ পাওয়া যাবে বর্তমান সংকলনে। মার্চ, ১৯৩২ থেকে ডিসেম্বর, ১৯৪১ পর্যন্ত যে সব রবীন্দ্র-সংবাদ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাদের মধ্য থেকে ৭টি নির্বাচিত বিষয়ের সংবাদ বর্তমান খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। এই খণ্ডের বিষয়বিভাগগুলি হল : সভাসমিতি, শ্রদ্ধাঞ্জলি, গ্রন্থপরিচিতি, ভ্রমণ দেশে, ভ্রমণ বিদেশে, আন্তজাতিকতা ও বিবিধ প্রসঙ্গ। এই পর্বেরই ৫টি বিষয় বিভাগ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জীবনের শেষলগ্নে কবি উপলব্ধি করেছিলেন যে রাজনীতিতে নৈতিকতার অভাবই যুদ্ধের মূল কারণ। পরাধীন ভারতের শান্তি স্থাপনে কোনাে ভূমিকা ছিল তাই কবি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে ধ্বংসলীলা বন্ধ করতে আহ্বান করেছিলেন। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন সর্বজাতিক মানবতাবাদই চিরন্তন শান্তির পথ প্রশস্ত করতে পারে। বিশ্বমৈত্রী শুধু রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের মিলনে সীমাবদ্ধ থাকবে না, মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন বিশ্বমৈত্রীর ভিত্তি সুদৃঢ় করবে। যুদ্ধের বিষাক্ত আবহাওয়ার মধ্যেও দেখা গিয়েছিল আসন্ন স্বাধীনতার ক্ষীণ আলােকরশ্মি। কবি উপলব্ধি করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আগতপ্রায়। স্বাধীন নাগরিকের চরিত্র যে ভাবে গড়ে ওঠা প্রয়ােজন সে কথা কবি অনেকবার ছাত্রদের বুঝিয়ে বলতে চেয়েছেন। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অস্বাস্থ্য এসব থাকলে দেশে প্রকৃত স্বাধীনতা সম্ভব নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে কবি যে কত আগ্রহী ছিলেন তার অনেক প্রমাণ বর্তমান সংকলন থেকে আমরা পাই। স্বদেশীযুগে তিনি নানা ব্যবসার পত্তন করেছিলেন, হিন্দুস্থান কোঅপারেটিভ ইন্সিওরেন্সের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন কবি। খাদ্যপুষ্টি, ফুকাপ্রথা, যক্ষ্মারােগ নিবারণ, বেকার সমস্যা, বাংলার তাঁতশিল্প, মাতৃমঙ্গল, জনবিস্ফোরণ, জড়বুদ্ধি শিশুদের সমস্যা প্রভৃতি নানা বিচিত্র বিষয়ে কবির সুচিন্তিত মতামত এখনও আমাদের পথ নির্দেশ করতে পারে। এই সংকলনের একটি উল্লেখযােগ্য প্রসঙ্গ হল কবির স্মৃতিচারণ। অনেক স্বল্পজ্ঞাত তথ্য এর থেকে জানা যায়। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে একদিনের জন্য বহিরঙ্গ ছাত্র ছিলেন। ঠাকুরবাড়িতে নিঃসম্বল আশ্রিতা বিধবারা প্রায়ই কলহে মত্ত হয়ে উঠতেন, ঝগড়া মেটাতেন সারদা দেবী। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যে সংস্কৃতিধারা প্রবহমান ছিল তার সুন্দর বিবরণ কবির স্মৃতিচারণা থেকে জানতে পারি। আলােচ্য পর্বে কবির প্রায় ৬০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। অনেকগুলির সমালােচনা এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত। কবির জীবিতকালে তাঁর বইয়ের সমালােচনা কেমন হত, সেই সম্বন্ধে কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। নবীন লেখকদের কবি বড় একটা উপদেশ দেন নি, এক সভায় কবি তাঁদের বলেছেন, লেখার সাধনা কঠিন আবরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র লেখকদের যে তিনটি উপদেশ দিয়েছেন তার সঙ্গে এই উপদেশটিও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বর্তমান সংকলনে কবির দেশে ও বিদেশে ভ্রমণের বিবরণ পাওয়া যায়। ইরাক-ইরান, সিংহল তিনি ভ্রমণ করেছেন বৃদ্ধ বয়সে। বিদেশ ভ্রমণের উল্লেখযােগ্য অভিজ্ঞতা হল এই যে, সে সব দেশে সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধি নেই। উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের বহু স্থানে তিনি গিয়েছেন এবং বিশ্বভারতীর আদর্শ ব্যাখ্যা করেছেন। বিদেশে কবি রাজকীয় সংবর্ধনা লাভ করেছেন। দেশেও তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন বিপুলভাবে। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য সংবর্ধনা পেয়েছেন উড়িষ্যা থেকে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলবৎ হবার পর। শ্রদ্ধা যেমন তিনি পেয়েছেন, দিয়েছেনও অকুণ্ঠভাবে দেশ ও বিদেশের মনীষীদের উদ্দেশে। তুলসীদাস, রামমােহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, কামালপাশা, ইয়েটস, হুইটম্যান প্রমুখ মনীষীরা তাঁর শ্রদ্ধার পাত্র। শ্রদ্ধার সঙ্গে নিন্দাবাদও পেয়েছেন কবি। অভিযােগ করা হয়েছিল তিনি। কলাকৈবল্যবাদী লেখক, দেশের মাটির সঙ্গে তাঁর যােগ নেই—“বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ নাচ, গানের। সাহায্যে অর্থোপার্জন রূপ যে দুর্গতিপঙ্কের মধ্যে নিমজ্জিত হইয়াছেন, তাহাও আমাদের মনে রাখিতে হইবে।” এই সমস্ত নিন্দাবাদ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগে কবি নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন, “আমার জন্মভূমি আমাকে গ্রহণ করেছেন নগ্নদেহে, বিদায় দেবেন নগ্ন সম্মানে।”
চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৫ সালে, বিক্রমপুর, ঢাকায়। শিক্ষা: ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবনের প্রথমে জাতীয় গ্রন্থাগারের উপ-গ্রন্থাগারিক। পরবর্তীকালে সেন্ট্রাল রেফারেন্স লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক। গ্রন্থাগার আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। শ্ৰীবন্দ্যোপাধ্যায় প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, গবেষক ও গ্রন্থসম্পাদক। তাঁর সম্পাদিত বিশিষ্ট গ্রন্থ আনন্দমঠ (রচনার প্রেরণা ও পরিণাম), রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ: আনন্দবাজার (চারখণ্ড)। বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে লেখকের অন্যান্য বই : সোনার আলপনা, বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায়, লেখকের গল্প। দুরের বই এই ধারায়, আর একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।