ভ্রমণ নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি উক্তি হলো- ভ্রমণ ছাড়া মেধা বিকাশ সম্ভব নয়। ভ্রমণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ভ্রমণের মাধ্যমে বন্ধুদের ভালো করে যাচাই করা যায়। ভ্রমণের মধ্য দিয়ে পদচিহ্ন ভুলে যাও আর স্মৃতিগুলো নিয়ে নাও, বলেছেন স্যাটেল। প্রখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু দালাই লামার মতে- প্রতি বছর এমন একটি জায়গায় ভ্রমণ করা উচিৎ যেখানে এর আগে কখনই যাওয়া হয় নি। গুস্তাভ ফ্লুবার্ট বলেন, ভ্রমণ মানুষকে পরিমিত করে তোলে। ভ্রমণ অনুভব করতে শেখায় একজন মানুষ বিশাল পৃথিবীতে কত ছোট জায়গা দখল করে আছে। আন্ড্রে গিডের মতে, তীরে দৃষ্টি হারানোর সাহস না থাকলে মানুষ নতুন মহাসাগর আবিষ্কার করতে পারে না। আর মার্ক টোয়েনের ভাষায় বলতে হয়- কুসংস্কার, গোঁড়ামি এবং সংকীর্ণতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভ্রমণ হলো মহৌষধ। সেন্ট অগাস্টাইন মনে করেন, পুরো পৃথিবী একটি বই এবং যারা ভ্রমণ করে না তারা কেবল এর একটি পৃষ্ঠা পড়ে।
সত্যি বলেছেন সেনেকা, ভ্রমণ এবং স্থান পরিবর্তন, মনে নতুন উদ্যম জোগায়। আমিও মনে করি, আপনি যেখানেই যান না কেন, সেটা কোনো না কোনোভাবে আপনার অংশ হয়ে যায়। সান্দ্রা লেকের কথায় দেখতে পাই, বয়সের সাথে বুদ্ধি আসে, ভ্রমণের সাথে অভিজ্ঞতা আসে। কথাটা কি একেবারে ফেলে দেয়ার মতো?
ভ্রমণ সকল মানুষের আবেগকে বাড়িয়ে তোলে; তেমনি একথাও সত্য যে, ভ্রমণ করে কেউ কখনো গরীব হয়ে যায়নি। ভ্রমণে যে অভিজ্ঞতা হয়, পৃথিবীর আর অন্য কোন কিছুতেই তা পাওয়া যায় না। তবে ভ্রমণের কথা বলতে গেলে একটা কথা অবশ্যই বলতে হয়, যতক্ষণ না আপনি নিজেকে পিছনে ফেলেন, ততক্ষণ ভ্রমণ দুঃসাহসিক হয়ে ওঠে না। কর্ম একজনের পকেট পূর্ণ করে, ভ্রমণ করে আত্মাকে পূর্ণ। অর্থের বিনিময়ে সুখ কিনতে না পারলেও ভ্রমণের জন্য টিকিট কিনতে পারেন, এটা সুখ কেনার সমতুল্য। জীবন থেকে পালানোর জন্য কেউ ভ্রমণ করে না, বরং জীবন যাতে আমাদের থেকে পালিয়ে না যায়, সে জন্যই ভ্রমণ করা। আমি মনে করি, জীবনটা সংক্ষিপ্ত এবং পৃথিবীটা অনেক বড়, তাই যতো তাড়াতাড়ি এর অন্বেষণ শুরু করা হবে, ততোই ভালো। ভ্রমণ জীবনের একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; ভ্রমণ যা দেখায় তা মানচিত্র কখনই দেখাতে পারে না। ভ্রমণ তা-ই শেখায় যা পুরো লাইব্রেরি কখনই শেখাতে পারে না। যত বেশী ভ্রমণ করা যাবে ভয়ের সীমা ততটাই সঙ্কুচিত হবে এবং চিন্তার পরিধি প্রসারিত হবে। আবার এ কথাও মনে রাখতে হবে, একজন বুদ্ধিমান ভ্রমণকারী কখনোই তার নিজের দেশকে তুচ্ছ করে না। ভ্রমণ হতে পারে রোম্যান্সের জন্য, হতে পারে স্থাপত্য দেখার জন্য বা হতে পারে ক্ষণিকের তরে হারিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই, যদি কোথাও যেতে মন চায়, তাহলে আজই যাওয়া উচিত; কারণ কাল কি হবে তা কেউ বলতে পারে না।
ভ্রমণ একজন মানুষকে প্রথমে বাকরুদ্ধ করে, তারপর তাকে গল্পকারে পরিণত করে।
যিনি একাকীত্বে ভোগেন তার জন্য কার্যকর হলো ভ্রমণ। তবে আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, আপনি যাকে পছন্দ করেন না, তার সাথে কখনো ভ্রমণে যাবেন না। তাতে আপনার ভ্রমণ নিরানন্দময় হয়ে উঠতে পারে। ভ্রমণে গিয়ে যে স্মৃতি তৈরি হয়, সেই স্মৃতিগুলো সারাজীবন আমাদের সাথে থাকে। আমার কাছে ভ্রমণ ছাড়া জীবন স্বাদ ছাড়া তরকারীর মতো। ভ্রমণের ক্ষেত্রে বয়সও কোন বাঁধা হতে পারে না। বেড়াতে গেলে টাকার চেয়ে বেশী দরকার মন। ভ্রমণের আবেগ জীবনের একটি আশাব্যঞ্জক লক্ষণ। গুস্তাভ ফ্লুবেয়ার বলেন, ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে এবং জানতে পারে পৃথিবীর তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র- কথাটা একেবারেই সত্য।
‘বাংলার পথে প্রান্তরে’ বইয়ের ভূমিকায় বলেছিলাম, আমরা বাঙালিরা বিদেশ ভ্রমণে যতটা আগ্রহী, দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণে ততটা আগ্রহী নই। প্রথমত আমাদের জ্ঞানের অভাবের কারণে আমরা জানিই না, পৃথিবী নামক গ্রহের সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ বাংলাদেশে দেখার মতো কত কিছু রয়েছে! রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক ভান্ডার। আছে বিশাল সমুদ্র, পাহাড়, হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল আর দেশজুড়ে অসংখ্য খাল-নদী-নালা। সমতল ভূমির দেশ হলেও এর প্রাকৃতিক গঠনে রয়েছে নানান বৈচিত্র। দেখার মতো চোখ থাকলে বিদেশে যেতে হয় না। মূলত আমরা খুঁজে ফিরি আধুনিক অট্টলিকার বহর, যা মনুষ্য সৃষ্টি। প্রকৃতিকে ভালোবাসলে বাংলাদেশের মতো এত সুন্দর দেশ আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটা সময় ছিলো দেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে অনেকেই ভ্রমণে আগ্রহী হতেন না, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। দুর্গম স্থানগুলোতেও এখন নিয়মিত যাতায়াত ব্যবস্থা চালু হয়েছে। দিন যত যাবে, ততই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। পেশাদার গাইড ব্যবস্থার প্রচলন এখনো তেমনটা না হলেও, আমি অন্তত আশাবাদী। সবচেয়ে করুন অবস্থা- নিরাপত্তা। এর অভাব এখনো রয়েছে, তবে স্থানীয় জনসাধারণ পর্যটকদের ব্যাপারে অনেকটাই সচেতন আগের থেকে,আশা- করি অবস্থার আরো উন্নতি হবে। একাজে স্থানীয় প্রশাসনকে আরো উদ্যোগী হতে হবে।
বর্তমানে দেশের বহু স্থানে ভ্রমণ পিয়াসীদের জন্য বিলাসবহুল রিসোর্ট-কটেজ নির্মিত হলেও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ স্থানগুলোয় এখনো গড়ে ওঠেনি সুসংগঠিত ভ্রমণ-প্যাকেজ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ আরো বাড়ানো দরকার। নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন এবং সহজলভ্য আবাসন ব্যবস্থাই হচ্ছে পর্যটনের মূখ্য বিষয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো আমাদের মহামূল্যবান সম্পদ। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এমন নিদর্শনগুলোর সামনে একটি সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত। রক্ষণাবেক্ষণের কোন উদ্যোগ নেই বলাটাই যুক্তিযুক্ত। এগুলো নিয়ে প্রচারের কাজে এগিয়ে আসতে হবে সরকারের পর্যটন বিভাগকে, যা একেবারেই দৃষ্টিগোচর নয়।
দেশের অভ্যন্তরে আমার কিছু ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশিত ‘বাংলার পথে প্রান্তরে’ বইটির বর্ধিতাংশ বলা যেতে পারে এবারের বইটিকে। বরাবরের মতো এবারের ভ্রমণ বৃত্তান্তেও কখনো একাকী, কখনো সদলবলে ভ্রমণের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। ভ্রমণ কাহিনীতে সাধারণত যেগুলো থাকে তার মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থা, আবাসন ব্যবস্থা ও খরচের হিসাব, আমার বর্ণনার মধ্যে সেগুলো বিস্তারিত নেই। কে কোন স্থান থেকে যাত্রা শুরু করবেন তার ওপর এগুলো নির্ভর করে, যাতায়াত ভাড়া ও আবাসন ব্যয় পরিবর্তনশীল, তাই এগুলো লিখে বইয়ের কলেবর বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাই নি। এছাড়া, ভ্রমণ বর্ণনায় যতগুলো সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো তাৎক্ষণিক উল্লেখ করায় আলাদা করে সূত্রের তালিকা ব্যবহার করিনি।
আমার ভ্রমণ বর্ণনা কারো কারো ভাল লাগবে, আবার কারোর মনপূত নাও হতে পারে। দর্শণীয় স্থানগুলো সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়ার সাথে সাথে স্বীয় অভিজ্ঞতা লিখে রাখাই আমার উদ্দেশ্য। এতে করে দু’চার জন যদি ভ্রমণে উৎসাহী হন, সেটাই হবে আমার বড় পাওয়া।
আমার এ প্রচেষ্টা যদি পাঠকের ভালো লাগে তবে নিজেকে ধন্য মনে করবো। কারো যদি কোন অভিযোগ বা পরামর্শ থাকে- নিঃসঙ্কোচে তা আমাকে জানাতে অনুরোধ জানাচ্ছি।