পৃথিবীর যে-কোনও বড় শহরেরই চালচিত্র জুড়ে রয়েছে নিজস্ব এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যেরই বড় পরিচয় আবার ছড়িয়ে থাকে তার বিভিন্ন স্থাপত্যকর্মে, সৌধমালায় এবং স্মৃতিস্তম্ভে। এগুলোই ধরে রাখে শহরের অতীত ইতিহাস, জেগে থাকে তার সৌন্দর্য ও মহিমার মূর্ত প্রতীক হয়ে।কলকাতাও এমনই এক বিশিষ্ট শহর—যার পরতে-পরতে মিশে আছে ঐতিহ্য ও ইতিহাস। আছে তার চোখ-ভোলানো স্থাপত্যে, তার স্মৃতি ও সম্ভ্রম জাগানো ঘরবাড়িতে। আছে সড়কে-সেতুতে, আছে মন্দিরে-মসজিদে, আছে গির্জায়-গঙ্গাতীরে, আছে শ্মশানে-সমাধিক্ষেত্রে।কিন্তু এই ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অনেকটাই আজ ধ্বংস ও অবলুপ্তির পথে। অনেকক্ষেত্রে নিশ্চিহ্নও| বহুতল অট্টালিকার আগ্রাসী বিস্তার, পাতালরেলের খোঁড়াখুঁড়ি, রক্ষণাবেক্ষণে অযত্ন-অবহেলা, ঐতিহ্য-সচেতনতার অভাব—এবংবিধ বিস্তর কারণে কলকাতা শহরের দশা দিনে দিনে দীর্ণ, জীর্ণ, মলিন, জর্জর, হতশ্রী। ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যে গরীয়ান এই শহর কলকাতা ও তার ধ্বংসোন্মুখ পরিবর্তমান চেহারাটাকে দীর্ঘকাল যাবৎ সুসংবদ্ধভাবে সুচারু আঁচড়ে চিত্রবন্দী করে চলেছেন খ্যাতনামা প্রবীণ চিত্রশিল্পী রথীন মিত্র। এই গ্রন্থে তাঁর সেই চিত্রাবলি সংকলিত হল। সন্দেহ নেই, কলকাতা সম্পর্কে তাঁর ভালবাসা ও সচেতনতারই এক চিরন্তন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এই অ্যালবাম। শ্ৰীমিত্রের ছবির সঙ্গে যাঁদের পরিচয় রয়েছে তাঁরাই জানেন, কাগজে তাঁর রেখাঙ্কনের নির্দিষ্টতা ও প্রামাণিকতা এত নিখুঁত যে, এচিং-এর আভাস আসে। মনে হয়, পুরো দৃশ্যটাই উঠে এসেছে ভিতর থেকে। তাঁর পেন ও কালি-তে ড্রইং নয়নাভিরাম। মেকী বিমূর্ত তত্ত্বকথায় কখনো টলে যাননি রথীন মিত্র। শিল্পী হিসেবে বরাবরই তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী এবং সৎ। সেই সাধুতা এবং প্রত্যয়ের পরিচয়ও এই সংগ্রহের প্রতিটি ছবিতে।আধুনিক ভারতীয় শিল্পীদের ভেতর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে যে কজন নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন শিল্পীরসিকদের মনে, রথীন মিত্র তাঁদের অন্যতম। ভারতের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের রাস্তা, ঘাট, মন্দির-মসজিদ-চার্চ-গুরুদ্বার, ঐতিহাসিক বাড়ি রথীন মিত্রের রেখাঙ্কনে পৌঁছে গেছে সংবাদপত্র, পত্রিকার পাতায় পাতায়, আমাদের ঘরে। কন্যাকুমারী থেকে লাদাক, ইউরোপ, দূরপ্রাচ্যের নানা দেশের বিখ্যাত শহর বা অজানা প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন শ্রীমিত্র।