"কিমিয়ায়ে সাআদাত ১ম খণ্ড" বইটি সম্পর্কে ভেতরের কিছু অংশ: মহাত্মা ইমাম আল-গাযালী রহমতুল্লাহ আলাইহির গ্রন্থাবলী বিশ্ব-সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সুধীসমাজ তাহার গ্রান্থাবলী সমভাবে সমাদর করিয়া থাকেন। তঁাহার বেশ কয়েকখানা গ্রন্থ দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হইয়া জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে। | খৃষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন অনৈসলামিক ভাবধারা মুসলিম সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে এমন প্রচ্ছন্ন অথচ ব্যাপকভাবে প্রবেশ লাভ করে যাহার ফলে সত্য সনাতন ইসলাম ধর্ম বিপদগ্রস্ত ও ধ্বংসােম্মুখ হয়। সেই সংকট মুহূর্তে আবির্ভাব হয় হুজ্জাতুল ইসলাম জগবরেণ্য ছুফীকুল শিরােমণি আবু হামেদ মুহাম্মদ বিন আহমদ আল-গাযালী রহমতুল্লাহ্ আলাইহি। ইসলামী উলুম ও ফনূনে তাহার অগাধ পাণ্ডিত্য, অনন্য সাধারণ ধীশক্তি, দার্শনিক প্রজ্ঞা, সর্বোপরি ইলমে মারেফাত বা আধ্যাত্মিক বিদ্যার সাহায্যে ইসলামী শরীঅত এবং জীবন-দর্শনের নিগূঢ় তথ্য, ইহ-পারলৌকিক জীবনধারার সারগর্ভ বিশ্লেষণ অতি সহজ-সরল ও প্রাঞ্জলভাবে তিনি মুসলিম জাতির সম্মুখে উপস্থাপিত করেন তাহার শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে। কাজেই মুসলিম জাতির নিকট ইমাম ছাহেবের অমর অবদানের গুরুত্ব সর্বজন স্বীকৃত। বস্তুতঃ তাঁহার গ্রন্থাবলী মুসলিম জাহানে সমভাবে সমাদৃত হইয়া আসিতেছে। বর্তমান দুনিয়ার বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে মুসলিম সমাজ-জীবন, ঈমান-আমল যেভাবে গায়ের ইসলামী ভাবধারায় আচ্ছন্ন ও আড়ষ্ট হইতে চলিতেছে, তাহা রােধ করিবার অন্যতম উপায় হইতেছে ইমাম আগাযালীর মত মুসলিম মনীষীদের গ্রন্থাবলীর ব্যাপক প্রসার লাভ করা। | বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজের নিকট ইমাম আল-গাযালী পরিচিত হইয়া উঠেন তাহার অন্যতম অমর গ্রন্থ কিমিয়ায়ে সাআদাত-এর বাংলা অনুবাদ—সৌভাগ্য স্পর্শমণির মারফত। তরজমাখানি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনা আনয়নে সবিশেষ সহায়ক হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় সৌভাগ্য স্পর্শমণির মত এমন উপাদেয় গ্রন্থখানি ১৩৫২/১৯৪৫ সনের পর আর প্রকাশ করা হইতেছে না; ফলে সুধীসমাজে গ্রন্থখানির অভাব মর্মে মর্মে অনুভব করা হইতেছে। এই অভাব মােচনের জন্য মাওলানা নূরুর রহমান ছাহেব দীর্ঘ দিন একনিষ্ঠ চেষ্টা ও যত্ন সহকারে মূল ফারসী কিমিয়ায়ে সাআদাত এর বঙ্গানুবাদ প্রথম খণ্ড সমাধা করিয়াছেন। আমি পুস্তকখানির পান্ডুলিপি আগ্রহ সহকারে পাঠ করিয়াছি। তরজমার ভাষা সুন্দর ও প্রাঞ্জল হইয়াছে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি নিঃসন্দেহে বলিতে পারি যে, পুস্তকখানি সুখপাঠ্য ও উপাদেয় হইয়াছে এবং খােদা চাহেন তাে মুসলিম সমাজের বিশেষ উপকার সাধন করিবে। আমি পুস্তকখানির বহুল প্রচার কামনা করি।
বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ., সংক্ষেপে ইমাম গাজ্জালী ছিলেন একজন সুফিসাধক ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাবিদ, যিনি তাঁর দর্শন ও চিন্তাধারা বিশ্ব মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর পারিবারিক ব্যবসা সুতা সংক্রান্ত হওয়ায়, সেখান থেকে তার নাম গাজ্জালী হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যেহেতু 'গাজ্জাল' শব্দের অর্থ সুতা। ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি ৪৫০ সাল) ইমাম গাজ্জালী ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং এই তুস নগরীতেই তার শৈশবকাল ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি ইসলামের স্বর্ণযুগে জন্ম নেন, যে যুগে শিক্ষা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে মুসলমানরা অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো। একইসাথে বিস্তার লাভ করেছিলো পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শনেরও। ইমাম গাজ্জালী এসকল বিষয়েই দীক্ষা লাভ করেন এবং বিশেষ করে ঐ যুগের বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনির কাছ থেকে ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। মুসলিম দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ফিকহশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী । জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান বাগদাদের সেরা বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনা করেন। তিনি তৎকালীন বাদশাহর দরবারেও আসন লাভ করেন। তবে সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিষয়ে তীব্র আকর্ষণ থাকায় তিনি জ্ঞান আহরণের জন্য দেশ-বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন ও নানা বিষয় সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। ইমাম গাজ্জালী রহ. বই রচনার মাধ্যমে তাঁর অর্জিত এসকল জ্ঞান মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ. এর বই সমূহ-তে তিনি আলোচনা করেছেন সুফিবাদ, ইসলামি দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে, এবং তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা চার শতাধিক। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ. এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'আসমাউল হুসনা', 'মিশকাতুল আনোয়ার', 'ফাতাওয়া', 'মিআর আল ইলম', 'হাকিকাতুর রুহু', 'দাকায়েকুল আখবার' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১১১১ খ্রিস্টাব্দে (৫০৫ হিজরি) তিনি নিজ জন্মভূমি তুস নগরীতে মৃত্যবরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় একজন মনীষী।